শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫

তেজগাঁও-মিরপুরে ছিনতাইকারী বেশি

প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » তেজগাঁও-মিরপুরে ছিনতাইকারী বেশি
শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫



তেজগাঁও-মিরপুরে ছিনতাইকারী বেশি

ঢাকার ব্যস্ত সড়কে গাড়ির স্রোত। হঠাৎ চাপাতি হাতে তিন যুবক প্রাইভেটকারের যাত্রীর হাত থেকে মোবাইল ফোনসেট ছোঁ মেরে নিয়ে দিল ভোঁ দৌড়। ছিনতাইয়ের এ দৃশ্য মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ঘটনাটি ১৬ ডিসেম্বর আসাদগেট এলাকার। এর দু’দিন পর ঢাকার হানিফ ফ্লাইওভারে ছিনতাইকারীর হাতে প্রাণ হারান হাফেজ কামরুল হাসান। ছুরিকাঘাত করে টাকা ও মোবাইল ফোনসেট কেড়ে নেওয়া হয় তাঁর। ১৫ ডিসেম্বর ঢাকার মগবাজারে হাবিব উল্লাহ নামের এক তরুণ ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন।

রাজধানীতে এভাবে প্রতিনিয়ত ঘটছে ছিনতাই; গত পাঁচ মাসে ছিনতাইকারী নিভিয়েছে সাতজনের প্রাণ। গুরুতর জখম করা হয়েছে কয়েকজনকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, ছিনতাই বেড়েছে। রাজধানীতে সক্রিয় ছিনতাইকারীর তালিকা তৈরি করছে পুলিশের একটি বিশেষায়িত ইউনিট। ওই তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মিরপুর ও তেজগাঁওয়ে ছিনতাইকারীর সংখ্যা বেশি। দ্বিতীয় স্থানে আছে ওয়ারী ও মতিঝিল এলাকা। এর পর উত্তরা ও গুলশান। তালিকাভুক্ত ছিনতাইকারীর মধ্যে চতুর্থ স্থানে আছে রমনা ও লালবাগ। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। রাজধানীতে ঘুরেফিরে ছিনতাই করছে, এমন সক্রিয় সদস্য ৬১৪ জন। এর বাইরে ভাসমান ও মৌসুমি ছিনতাইকারী রয়েছে কয়েকশ। রাজধানীর ছিনতাইয়ের হটস্পট আড়াইশর বেশি।

গতকাল বুধবার এক অনুষ্ঠানে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, ‘ইদানীং যে অপরাধটি মানুষের মধ্যে শঙ্কার সৃষ্টি করেছে, সেটি ছিনতাই। ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশই মাদকাসক্ত। ১৫ থেকে ২২ বছরের ছেলেরা মাদকে আসক্ত হয়ে এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।’

র‍্যাব সদরদপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস গণমাধ্যমকে বলেন, ছিনতাইকারীর স্পটগুলো শনাক্ত করেছি। আগে থেকে যারা ছিনতাই করে আসছে তাদের ওপর নজর রাখছি। আবার নতুনভাবে কেউ জড়িয়ে পড়েছে কিনা, সেদিকেও খেয়াল রাখা হচ্ছে। তবে মাদক স্পটের আশপাশে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে। নৈশকোচের যাত্রীদের টার্গেট করা হচ্ছে বেশি। টহল কার্যক্রম ও তল্লাশি চৌকি জোরদার করা হয়েছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, মামলার রেকর্ড দেখে ছিনতাইয়ের বাস্তব অবস্থা নিরূপণ করা সম্ভব নয়। মূলবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেওয়ার পরও প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে অনেকে মামলা করেন না। ছিনতাইকারীর পেছনে সিন্ডিকেট ও পৃষ্ঠপোষক আছে। নিরাপত্তার বিষয়ে সাধারণ জনগণকে ভাবিয়ে তুলছে।

তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনও শতভাগ সক্রিয় হতে পারেনি। আবার যারা নতুন দায়িত্বে এসেছেন, তাদের সব কিছু বুঝে উঠতে সময় লাগছে। এ সুযোগ নিচ্ছে ছিনতাইকারীরা। কোথাও তারা টার্গেট ছিনতাই করছে। তাদের হাতে অস্ত্র দেখা যাচ্ছে। জড়িত অনেকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর দ্রুত জামিনে বেরিয়ে আসছে। এর পর আবার ছিনতাইয়ে জড়াচ্ছে। যারা বারবার একই অপরাধ করছে, তাদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সুপথে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।

পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর বিভিন্ন থানায় আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৬৫টি। গত বছরের জানুয়ারিতে ছিনতাইয়ের মামলা ২৫, ফেব্রুয়ারিতে ২৬, মার্চে ২৮, এপ্রিলে ১৫, মে মাসে ১৯, জুনে ১৬ ও জুলাইয়ে ১৫টি। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর ঝিমিয়ে পড়ে থানার কার্যক্রম। তাই এ সময়ে মামলা-জিডির পরিসংখ্যান দিয়ে অপরাধের প্রকৃত চিত্র নির্ণয় করা কঠিন।

শীর্ষে মিরপুর-তেজগাঁও

পুলিশের একটি বিশেষায়িত ইউনিটের তৈরি করা তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, মিরপুর ও তেজগাঁও বিভাগে সক্রিয় ছিনতাইকারী ২০৪ জন। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। ছিনতাইকারীর অধিকাংশের বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছর। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ছিনতাইকারীর মধ্যে রয়েছে তিনটি ভাগ। এক গ্রুপ পেশাদার। তারা বছরের পর বছর একই কাজ করে। একাধিকবার গ্রেপ্তারের পর আবার জামিনে বেরিয়ে একই অপরাধে জড়াচ্ছে। তারা আয়-রোজগারের উপায় হিসেবে ছিনতাই বেছে নিয়েছে। এই গ্রুপটি অস্ত্র হাতে ছিনতাইয়ে নামে।

আরেকটি গ্রুপ আছে ভাসমান ও মৌসুমি ছিনতাইকারী। তারা অধিকাংশ সময় ভাড়াটে হিসেবে কাজ করে। অনেক সময় নেশার টাকা জোগাতে ছিনতাই করছে। তৃতীয় আরেকটি গ্রুপ পেছন থেকে ছিনতাইকারী গ্রুপ চালায়। গ্রুপের কোনো সদস্য গ্রেপ্তার হলে তারা সহযোগিতার হাত বাড়ায়। আবার অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসাধু বর্তমান ও সাবেক সদস্যদের যোগসূত্র থাকে।

পুলিশের তালিকায় তেজগাঁও ও মিরপুর এলাকায় যেসব ছিনতাইকারী রয়েছে তারা হলো– মো. শরীফ, সাব্বির, মেহেদী হাসান, সুমন হাওলাদার, মিলন শেখ, জিহাদ, ইমন, মো. রফিকুল প্রমুখ। মতিঝিল ও ওয়ারী বিভাগে তালিকাভুক্ত ছিনতাইকারী ২০০। এর মধ্যে আছে– মো. বাবুল, রাজীব আহমেদ, শাওন গাজী, সজিব হোসেন, মো. রাসেল প্রমুখ। গুলশান ও উত্তরা অঞ্চলে তালিকাভুক্ত ছিনতাইকারী ১১২ জন। তাদের মধ্যে আছে– মাতবর, রাসেল খলিফা, মনির হোসেন, আসলাম মোল্লা, কাজী মামুন, সাহরাব ইমরান, শফিকুল ইসলাম বাবু প্রমুখ। রমনা ও লালবাগে তালিকাভুক্ত ছিনতাইকারী ৯৮ জন। তাদের মধ্যে আছে– শাওন, ফারুক, ইয়াসিন হোসেন রাজু, কোহিনুর বেগম মালা, লোকমান পাঠান প্রমুখ।

ছিনতাইয়ের হটস্পট

পুলিশের তালিকায় উত্তরা ও গুলশান অঞ্চলে ছিনতাইয়ের হটস্পট ৯৪টি। এর মধ্যে শাহজাদপুর ঝিলপাড়, প্রগতি সরণির হকার মার্কেটের সামনের এলাকা, গুলশান-বনানী সংযোগ সেতু, আশকোনা বাজার, ফায়দাবাদ কোটবাড়ি এলাকা, খিলক্ষেত ফুট ওভারব্রিজ, বিমানবন্দরের সামনের সড়ক, কাওলা আশিয়ান সিটি এলাকা, মহাখালীর আমতলী, বিমানবন্দর ৩ নম্বর টার্মিনালের আশপাশ, বনরূপা আবাসিক প্রকল্প, আজমপুর মোড় ও আবদুল্লাহপুর। মতিঝিল ও ওয়ারীর হটস্পটের মধ্যে আছে কমলাপুর রেলস্টেশন, খিলগাঁও রেলগেট, মতিঝিল শাপলা চত্বর, দক্ষিণ কমলাপুর, কুতুবখালী খালের মুখ থেকে মাছ বাজার পর্যন্ত, সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড, যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা, শনির আখড়া বাসস্ট্যান্ড, ধোলাইখাল চৌরাস্তা, করাতিটোলা মোড়, জুরাইন কবরস্থানের সামনে। মিরপুর ও তেজগাঁওয়ের হটস্পটের মধ্যে আছে সোনারগাঁও ক্রসিং, ফার্মগেটের আনন্দ হলের সামনের এলাকা, মহাখালী রেলক্রসিং, কাটাসুর নামাবাজার, রায়েরবাজার শশ্মানঘাট, ঢাকা উদ্যান, বেড়িবাঁধ তিন রাস্তার মোড়, মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজার, মিরপুর-১০, প্রশিকার মোড়, মিরপুর-১, রাইনখোলা, গাবতলী বাসস্ট্যান্ড বেনারসিপল্লি, ইনেডোর স্টেডিয়াম এলাকা, পল্লবী বাসস্ট্যান্ড, পল্লবী ২২ তলা গার্মেন্টের সামনে ও লালমাটিয়া টেম্পো স্ট্যান্ড।

পুলিশ জানায়, ঢাকায় সেপ্টেম্বরে ২৩, অক্টোবরে ৯১, নভেম্বরে ১৪৮ ও ডিসেম্বরে ৫৬৪ ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ছিনতাইয়ের শিকার এমন তিনজনের সঙ্গে কথা বলেছে গণমাধ্যম। তারা বলেছে, অনেক জায়গায় পুলিশ ঢিলেঢালা ডিউটি করছে। আবার রাত ও ভোরে কোনো কোনো এলাকায় টহল থাকে না। এর সুযোগ নেয় ছিনতাইকারীরা। আবার ছিনতাইকারীর হাতে অস্ত্র থাকায় কেউ এগিয়ে যাওয়ার সাহস করে না।

বাংলাদেশ সময়: ১:৪০:৩৪   ১০ বার পঠিত