সাভারের কলেজছাত্র মুনসের আলী মুন্না। ২০১৫ সালে তাকে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে হত্যা করে দুর্ধর্ষ কিলার বাদশা মিয়া ও তার সঙ্গীরা। মামলাটি
এখনো বিচারাধীন। একই আসামি একই সালে মানিকগঞ্জ কলেজছাত্র মনির হোসেনকেও নৃশংসভাবে হত্যা করে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ২০২২ সালের ২২শে আগস্ট ঢাকা জেলা জজ কোর্ট থেকে পালিয়ে যায় হত্যা মামলার এই আসামি। সম্প্রতি হত্যার শিকার মনিরের মা-বাবা, মামলার সাক্ষীদের হত্যার হুমকি দিয়েছে দুর্ধর্ষ কিলার বাদশা মিয়া। নিরাপত্তাহীনতার মধ্যদিয়ে দিন পার করছে এই পরিবার। শুধুমাত্র মামলা জটের কারণে এখনো শেষ হয়নি বিচার কার্যক্রম। দুই হত্যা মামলার একটি জজ কোর্টে বিচারাধীন আরেকটি হাইকোর্টে বিচারাধীন। এমন বহু মামলা বছরের পর বছর পড়ে আছে আদালতে। দুদকের একটি মামলা ৫ বছর পার হলেও শুরু হয়নি এখনো সাক্ষ্য নেয়ার কার্যক্রম। ২০১৯ সালের ২১শে নভেম্বর ৩০ কোটি ৩৫ লাখ টাকার সম্পদ অর্জন এবং ৩৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা সম্পদ বিবরণী গোপনের অভিযোগে সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক এম শামসুদ্দোহা খন্দকার ও তার স্ত্রী ফেরদৌসী সুলতানা খন্দকারের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলার তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৮৬ সালের ২৮শে আগস্ট সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন শামসুদ্দোহা। তিনি ২০১১ সালে অতিরিক্ত আইজিপি হন এবং ওই বছরের ১লা সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান ছিলেন। দায়িত্ব পালনকালে এলাকায় গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। অন্যের জমি দখল করে পার্ক বানানোরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সবেমাত্র আদালতে চার্জশিট দাখিল হয়েছে। তবে এখনো শুরু হয়নি সাক্ষ্য নেয়ার কার্যক্রম।
গত ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তদন্তাধীন ব্যতীত প্রকৃত বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫১০টি। বিচারক সংকট, অপ্রয়োজনীয় মামলা দায়ের, প্রসিকিউশন বিভাগের অদক্ষতা, একই মামলায় নানা কারণ দেখিয়ে আইনজীবীর অযাচিত সময় নেয়াসহ নানা কারণে মামলা জটের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা।
আদালত সূত্র জানায়, গত ১লা জুলাই থেকে ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তদন্তাধীন ব্যতীত প্রকৃত বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪২ লাখ ৩৪ হাজার ৩১৪টি। এরমধ্যে আপিল বিভাগে ২৮ হাজার ৯০১টি এবং হাইকোর্ট বিভাগে ৫ লাখ ৭৭ হাজার ২৮০টি মামলা বিচারাধীন। এ ছাড়া দেশের অধস্তন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৮ লাখ ৩৭ হাজার ৩২৯টি মামলা। এরমধ্যে ১৬ লাখ ৫ হাজার ৮০২টি দেওয়ানি এবং ২২ লাখ ৩১ হাজার ৫২৭টি ফৌজদারি প্রকৃতির মামলা বিচারাধীন।
কথা হয় হত্যার স্বীকার মনিরের মায়ের সঙ্গে। একমাত্র সন্তান মনিরের কথা মনে করে এখনো কান্না করে। নতুন করে যোগ হয়েছে ছেলে হত্যার খুনি কর্তৃক হত্যার হুমকি। মামলার খবর জানতে প্রশ্ন করা হলে ক্ষোভের সঙ্গে মনিরের পিতা পরশ আলী গণমাধ্যমকে বলেন, ছেলে হারালাম। এখন আবার আদালত থেকে পালানো আসামি বাদশা আমাদের পরিবারের সবাইকে রাতের আঁধারে আগুনে পুড়ে মারার হত্যার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। অথচ পুলিশ আসামির খোঁজ পাচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হত্যার আসামি বাদশা মিয়া দুর্ধর্ষ কিডন্যাপার দলের প্রধান। প্রথমে তার টার্গেট চাকরিপ্রত্যাশী স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রতি। এই মিশন নিয়ে খুঁজতে থাকে কাকে ট্র্যাপে ফেলা যায়। ট্র্যাপে ফেলতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে চাকরির অফার দেয়া হয় শিক্ষার্থীকে। লোভ দেখানো হয় মোটা অঙ্কের বেতন। যে শিক্ষার্থী ট্র্যাপে পড়ে প্রথমে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কিডন্যাপারদের আস্তানায়। সেখানে নিয়েই প্রথমে মারধর করা হয়। একপর্যায়ে পরিবারকে তার মোবাইল ফোন থেকেই কল করে মুক্তিপণ চাইতে বলা হয়। যে রাজি হয়, সে এ দফায় মারধর থেকে সাময়িক মুক্তি পান। আর যে রাজি হন না তাকে বেধড়ক পেটানো হয়। পেটানোর একপর্যায়ে সে ফোনে মুত্তিপণ চাইতে রাজি হয়। মুক্তিপণ চেয়ে কথা বলেন পিতা-মাতার সঙ্গে। এই কথোপকথন আবার মোবাইলে রেকর্ড করা হয়। এরপর তাকে ঘোরার কথা বলে সন্ধ্যার দিকে ট্রলারে নিয়ে যাওয়া হয় মানিকগঞ্জের সিংগাইর বংশী নদীতে। কিছুদূর যাওয়ার পর অপহৃতের হাত-পা নাইলন রশি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হয়। করা হয় মারধর। এরপর রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের বড় কনক্রিট শরীরে বাঁধা হয়। একপর্যায়ে ট্রলার থেকে তাকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দেয়া হয়। পরে ওই রেকর্ডকৃত ভয়েস পরিবারকে বারবার শোনানো হয়। এভাবে অপহৃতের মৃত্যু নিশ্চিত করে কিডন্যাপার গ্রুপ। এই গ্রুপের মূলহোতা বাদশা মিয়া এভাবে হত্যা করে মানিকগঞ্জ কলেজের শিক্ষার্থী মনির হোসেনকে। একইভাবে হত্যা করা হয় সাভার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষার্থী মুনছের আলী মুন্নাকে। বহু চেষ্টার পর মনিরের লাশের খোঁজ পেলেও দুইদিনেও মুন্নার লাশ খুঁজে পায়নি ফায়ার সার্ভিস। কিডন্যাপারদের একজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব তথ্য উঠে আসে। একজন কিংবা দু’জনকে নয় বহু শিক্ষার্থী হত্যার অভিযোগ বাদশার নেতৃত্বাধীন এই গ্রুপের বিরুদ্ধে। কিন্তু এর আগে কখনোই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তাদের পাকড়াও হতে হয়নি। মানিকগঞ্জের কলেজ শিক্ষার্থী মনির হোসেন ও সাভার কলেজের শিক্ষার্থী মুনছের আলী মুন্না অপহরণের বেলায় ধরা পড়ে এই গ্রুপ। মনির হত্যার ঘটনায় মামলা হয় মানিকগঞ্জ সদর থানায় এবং মুন্না হত্যার ঘটনায় মামলা হয় সাভার থানায়। মানিকগঞ্জ সদর থানার মামলায় বাদশা মিয়াসহ ৪ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে জেলা জজ কোর্ট। বাদশা ও লাল মিয়া ছাড়া সবাই পলাতক ছিল। কিন্তু ২০২২ সালের ২৮শে এপ্রিল এই দু’জনকে সাভার থানার মামলায় ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির করা হয়। ওইদিন এই মামলায় সাক্ষীর দিন ধার্য ছিল। জেলা জজ কোর্টের হাজতখানা থেকে আদালতে হাজির করা হয়। সাক্ষী না আসায় ৮ম তলায় অবস্থিত আদালতের এজলাস থেকে হাজতখানার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। নিচে নামানোর সময় ভবনের ৩ তলা থেকে দু’জনের একজন বাদশা মিয়া হাতকড়া খুলে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় হাজতখানার প্রধান হানিফ মিয়া কোতোয়ালি থানায় বাদী হয়ে মামলা করেন। ২ বছর পার হলেও পুলিশ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বাদশা মিয়াকে আটক করতে পারেনি। এ ঘটনায় কলেজছাত্র মনির হোসেন ও মুন্নার পরিবার চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এখনো এমন দুর্ধর্ষ আসামির পলায়ন এবং আটক না হওয়ায় নিহত মনিরের পিতা পরশ আলী হতবাক। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ওতো আমাদের আমার ছেলের মতো যেকোনো সময় আক্রমণ করে মেরে ফেলবে। আসলে ওর কথাই তো সত্য হলো। সম্প্রতি মনিরের মা মালেকা বেগম মামলাটি ডিবিতে হস্তান্তর করতে ডিএমপি কমিশনার বরাবর আবেদন করেন। আবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, এখনো আসামি বাদশা মিয়াকে আটক করতে না পারায় চরম উদ্বিগ্নের মধ্যে আমাদের দিন কাটছে। কেননা বাদশার মতো দুর্ধর্ষ খুনি যেকোনো সময় আমাদের দুই পরিবারের বড় ধরনের ক্ষতিসাধন করতে পারে। তাই আমাদের প্রতিটি রাত কাটে আতঙ্ক আর ভয়ে। বাদশা মিয়া মানিকগঞ্জ জেলা জজ কোর্টে বিচারকার্য চলার সময় আদালত প্রাঙ্গণেই আমাকে বেশ কয়েকবার হত্যার হুমকি দিয়ে বলেছে, আমি একদিন না একদিন জেল থেকে বের হবোই। তোর ছেলেকে যেভাবে হত্যা করেছি, তার চেয়ে ভয়ঙ্করভাবে তোকে খুন করবো। সূত্র জানায়, কোতোয়ালি থানায় দায়ের করা মামলাটি ডিবিতে হস্তান্তর করতে পুলিশের পক্ষ থেকেও একটি আবেদন করা হয়। ডিএমপি আবেদনটি আমলে নিয়ে মামলাটি ডিবিতে হস্তান্তর করেন।
বাংলাদেশ সময়: ৬:৩৭:১৬ ৩৯ বার পঠিত