বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪

পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে গণতন্ত্রের কবর রচনা করা হয়েছে

প্রথম পাতা » জাতীয় » পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে গণতন্ত্রের কবর রচনা করা হয়েছে
বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪



অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এম. আসাদুজ্জামান।

রাষ্ট্রের শীর্ষ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এম. আসাদুজ্জামান বলেছেন, একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েমের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়েছিলো। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করা হয়েছে। দীর্ঘায়িত করা হয়েছে ফ্যাসিবাদকে। রচনা করা হয়েছে গণতন্ত্রের কবর। কুঠারাঘাত করা হয়েছে সংবিধানের বুকে।

পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল প্রশ্নে জারিকৃত রুল শুনানিতে অংশ নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল হাইকোর্টকে এসব কথা বলেন। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চে বুধবার (১৩ নভেম্বর) এ শুনানি হয়।

মানুষকে ভয়ের সংস্কৃতিতে রাখা, মানুষের কণ্ঠ রোধ করা ও গনতান্ত্রিক সংগ্রাম থেকে জনগণকে দূরে রাখতেই পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের সঙ্গে (ক)(খ) উপ অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়েছে বলে হাইকোর্টকে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি বলেন, এটি মৌলিক অধিকারসহ সংবিধানে থাকা নাগরিকদের অধিকার ও সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্বকে আঘাত করেছে। একনায়কতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্যই এটি করা হয়েছে।

গণভোটের বিধান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে গণভোটের বিধান ছিলো। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে এই বিধানকে বিলোপ করা হয়েছে। এতে জনগণের মত প্রকাশের অধিকার খর্ব হয়েছে। এই বিধানটি আমরা পুনর্বহাল চাচ্ছি।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, যেভাবে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়েছে তা সংবিধানের ওপর প্রতারণার শামিল। এই সংশোধনী রাখা হলে মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ ও ২০২৪ সালে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের চেতনার পরিপন্থী হবে। যারা গণঅভ্যুত্থানে আত্মাহুতি দিয়েছে তাদের আত্মা কষ্ট পাবে। কারণ এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে বিরোধী মতাদর্শের ৭০০ মানুষকে গুম, ৪ হাজার মানুষকে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ৬০ লাখ মানুষ রাজনৈতিক মামলা ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। যা সবই রেকর্ডেড।

শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, দেশ স্বাধীনের পর ৭২ সালে আমরা একটা সংবিধান পেয়েছি। সেই সংবিধানের অধীনে ১৯৭৩ সালে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেশ সামরিক শাসনের অধীনে ছিলো। সেই স্বৈরশাসনকে বিতাড়িত করতে রাজপথে জীবন দিয়েছেন ডা. মিলন, নূর হোসেন, দীপালি, রউফুন বসুনিয়া, সেলিম-দেলোয়ারসহ অনেকেই। ৯০’র গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পতন হয় স্বৈরশাসনের। গঠিত হয় অন্তবর্তিকালীন সরকার। কিন্তু এই অন্তবর্তিকালীন সরকারে বিধান আমাদের সংবিধানে ছিলো না। জনগণের অভিপ্রায় এবং রাজনৈতিক ঐক্যমতের ভিত্তিতে তখন ওই সরকার গঠিত হয়।

শুনানির এক পর্যায়ে প্রখ্যাত আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের একটি অভিমত আদালতে তুলে ধরে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, উনি বলেছিলেন সাংবিধানিক স্কিমে না থাকলেও যদি জনগণের অধিকার রক্ষার জন্য সবাই ঐক্যমতে আসে সেটাই হবে সাংবিধানিক কাঠামো। এ জন্যই তখন রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে অন্তবর্তিকালীন সরকার গঠিত হয়েছিলো। সেই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে।

তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক ঐক্যমতের ভিত্তিতে সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। এই সরকার ব্যবস্থার অধীনে যে কয়টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে সেগুলো ছিলো বিতর্কমুক্ত। সুপ্রিম কোর্টের রায়কে পাশ কাটিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করে।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তৎকালীন সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন সেটা রায়ের আলোকে করেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রায়ে দুটি ইস্যু ছিলো। প্রথমটি হলো-তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাংবিধানিক না অসাংবিধানিক এই বিষয়ে চারজন বিচারপতি বলেছেন এটা অসাংবিধানিক। তিনজন বিচারপতি বললেন এটা সাংবিধানিক। দ্বিতীয় ইস্যু ছিলো-পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে কি হবে না। যেখানে ৭ জন বিচারপতিই পরবর্তী সংসদ নির্বাচন এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে হবে বলেছেন। ১৬ মাস পরে বিচারপতি খায়রুল হক রায় দিয়ে বললেন পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে কি হবে না এটা নির্ধারন করবে সংসদ। এটার সঙ্গে দুজন বিচারপতি একমত পোষণ করলেন। অপর তিন জন বিচারপতি বললেন- ওই সরকার ব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে বৈধ। রায়ে বিচারপতি এসকে সিনহা বললেন, পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে হবে। তবে সেই ক্ষেত্রে বিচার বিভাগকে বাদ রেখে প্রসিড করা উচিত। তাহলে এই ইস্যুতে ৩ বিচারপতি বললেন দুটি নির্বাচন হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে, তবে সেটা সংসদ নির্ধারণ করবে। এছাড়া পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে- এটার পক্ষে চার জন বিচারপতি মত দিলেন। ৩ জন বিচারপতি বললেন সংসদ নির্ধারন করবে। এটাকে সরকার সংবিধানের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। রায়ে ভুল ব্যাখ্যা করে সংবিধানকে এমন স্থানে নিয়ে গেছেন, যার জন্য গণতন্ত্রহীনতার দিকে গেছে বাংলাদেশ। এই সংশোধনী সংবিধানের সঙ্গে প্রতারণা। একটি নির্দিষ্ট দলের ক্ষকতাকে দীর্ঘায়িত করা ও ফ্যাসিজমকে প্রতিষ্ঠা করতেই ত্রয়োদশ সংশোধনীকে পাশকাটিয়ে (বাইপাস করে) এই সংশোধনী আনা হয়।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে এই নয় যে, হাজার হাজার মানুষকে গুম করা। বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে এটা নয় যে, ৬০ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে এগুলো হতে পারে না।

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা জাতির পিতা’র বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, উনি মুক্তিযুদ্ধের সময় অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন। ওনার অবদান অনস্বীকার্য। তবে আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় আমরা (উই) বলা হয়েছে। সেখানে একক কোন ব্যক্তির প্রাধান্য নেই, ব্যক্তিপুজার সুযোগ নেই। একজন ব্যক্তি সব কিছু করেছে এটা আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনার ধারণা নয়। সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘উ দ্য পিপল অব বাংলাদেশ’। আমরা সবাই স্বাধীন হয়েছি। এই কথা ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে আপিল বিভাগ বলেছে। উইনেস থেকে সরে এসে আমরা আইনেস এবং বায়োপিক থিউরিতে গেছি। এটা আমাদেরকে যেখানে নিয়ে যাচ্ছে, রাজনৈতিকভাবে যে জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, সেটা কাঙ্খিত না।

তিনি আরও বলেন, জাতির পিতা একক শব্দ ইস্যু নয়, ইস্যু হলো ওনাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার জন্য এবং যেভাবে করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে তার কৃতিত্বটাকেও ধংস করার জন্য ওনারা (তৎকালীন সরকার) দায়ী।

শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, টেরিটোরিয়াল জুরিসডিকশন অনুযায়ী দেশের নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশি পরিচয়ই একক ও অভিন্ন। আর আমাদের এখানে ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষও রয়েছেন যারা বাঙালি না। তাই সংবিধানে বাঙালি জাতি উল্লেখ থাকলে তারাও এটার মধ্যে চলে আসতে বাধ্য হয়।

সমাজতন্ত্র নয় গণতন্ত্রই আমাদের সংবিধানের মূল চেতনা উল্লেখ করে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতিতে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি’কে পুনর্বহালের যুক্তি তুলে ধরেন অ্যাটর্নি জেনারেল।

তিনি বলেন, আমরা সরকারের পক্ষ থেকে রুলকে সাপোর্ট করি। তবে পুরো পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল চাই না। কয়েকটা জায়গা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেছি। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের পদে বহাল রেখে যেভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে তাতে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছে। একটি সংসদকে বহাল রেখে আরেকটি সংসদ নির্বাচন করা অবৈধ। এটা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে আঘাত করে।

তিনি বলেন, সংবিধানের ১১৭ (ক) অনুচ্ছেদ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। পঞ্চম সংশোধনীতে তা বাতিল হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীতে তা ফিরিয়ে আনা হয় এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েমের জন্যই। এই অনুচ্ছেদ আমরা বাতিল চেয়ে আদালতে আবেদন জানান রাষ্ট্রের শীর্ষ আইন কর্মকর্তা।

শুনানিতে তাকে সহায়তা করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মো. আসাদ উদ্দিন। অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শেষে শুনানি শুরু করেন জামায়াতের ইসলামীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির।

বাংলাদেশ সময়: ২২:২৩:৩৫   ৫৫ বার পঠিত