মঞ্চে উঠলে যেন মুখে ফুটত খই, রীতিমতো বাকপটু। খেলা হবে! এমন বুলিতে যিনি হুংকার ছাড়তেন, তিনি শামীম ওসমান। তাঁর এই ‘খেলা হবে’ কথন পাশের দেশ ভারতের কলকাতাও লুফে নেয়। আওয়ামী লীগ আমলের পুরোটা সময় চলেছেন ডাঁটে-বাঁটে। সন্ত্রাস আর পেশির জোরে রাজত্ব করেছেন প্রাচ্যের ড্যান্ডি খ্যাত নারায়ণগঞ্জে। রাজনৈতিক ছায়ায় বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে পুরো নগরী রেখেছিলেন হাতের মুঠোয়। প্রকাশ্যে অস্ত্রসহ ২০-২৫টি গাড়ি নিয়ে মহড়া দেওয়া ছিল তাঁর নিত্যকাজ। আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদের আশকারায় শামীম ওসমান ছিলেন এলাকার ‘গডফাদার’। তাঁর প্রতাপে মানুষ ছিল ভয়াতুর।
কথিত আছে, নারায়ণগঞ্জে টাকা ওড়ে! নগরীর টাকার উৎস হাজার হাজার কলকারখানা। সেই টাকা ধরতে জানতেন শামীম ওসমান। এ কারণে সম্পদে ফুলে-ফেঁপেছেন। ১৯৯৬ সাল থেকে তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। বহু গুম-খুনের খলনায়ক তিনি। বিশেষ করে সাত খুন ও ত্বকী হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে শামীমের বিরুদ্ধে। তাঁর অঙ্গুলি হেলনে চলত দরপত্রবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, রাজনীতিবিদ ঘায়েল। কটাক্ষ, প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে রাখাসহ নানা কুকীর্তিতে শামীম ছিলেন দশে দশ! তাঁর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে ‘খেলা হবে’ বলেও ‘খেলা ফেলে’ তিন-তিনবার দেশ ছেড়ে পালান তিনি। একবার ২০০১ সালে, দ্বিতীয়বার ২০০৭ সালে, শেষবার ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর। এখন শামীম ওসমানহীন নগরে বইছে স্বস্তি; মানুষের মুখে মুখে তাঁর কুকর্মের আলাপন।
শামীমের জোয়ার-ভাটা
গণমাধ্যমের শিরোনাম হওয়াটা ছিল তাঁর বেশ পছন্দের। দোর্দণ্ড প্রভাবশালী আওয়ামী লীগের সাবেক এই সংসদ সদস্য (এমপি) গত সাড়ে ১৫ বছর নানাভাবে ছিলেন আলোচনায়। ২০০১ সালের নির্বাচনে ধুন্ধুমার কারচুপি করেও প্রভাবশালী এই নেতা নৌকা তীরে ভেড়াতে পারেননি। জোটপ্রার্থী গিয়াসউদ্দিনের কাছে ভোটে হেরে রাতের আঁধারে বোরকা পরে পালান শামীম ওসমান। একপর্যায়ে কানাডায় গিয়ে সেখান থেকে নিজের ক্যাডার বাহিনীকে নারায়ণগঞ্জে ঐক্যবদ্ধ করতে থাকেন। ২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌর নির্বাচনে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে সমর্থন দেন তিনি। সে সময় আইভীকে জেতাতে কানাডা থেকে নিজের নেতাকর্মীকে নির্দেশ দেন। শামীম ওসমানের চেষ্টা এবং আইভীর বাবা আলী আহম্মদ চুনকার ইমেজের কারণে আইভী নারায়ণগঞ্জের প্রথম নারী পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। দীর্ঘদিন কানাডায় পালিয়ে থাকার পর ২০০৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জে ফেরেন শামীম। শহরে ফিরেই শোডাউন করে নিজের শক্ত অবস্থান জানান দেন। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি বাতিল হওয়া নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে মহাজোটের মনোনয়নও পেয়ে যান এই ‘গডফাদার’। বিধিবাম! ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল করে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হলে ফের পালান তিনি। পলাতক অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে থাকা মামলায় সাত বছরের সাজা হয়। আইনি জটিলতার কারণে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের টিকিট থেকে বঞ্চিত হন আলোচিত এ রাজনীতিবিদ। সে সময় শামীম ওসমানের চাচি চিত্রনায়িকা সারাহ বেগম কবরী নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে মনোনয়ন পান। অন্যদিকে, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে মনোনয়ন পান তাঁর আপন বড় ভাই জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসিম ওসমান। কবরী ও নাসিম ওসমান দু’জনই সে নির্বাচনে জয়ী হন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ২০০৯ সালের এপ্রিলে ফিরে নারায়ণগঞ্জে আবারও গাঁড়েন সন্ত্রাসের খুঁটি। সেই থেকে ফের শুরু হয় ‘ওসমানীয় আমল’।
২০১১ সালে সিটি নির্বাচনে তিনি আইভীর কাছে ১ লাখ ১ হাজার ৩৪৩ ভোটে হেরে যান। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিট পান শামীম। এর পর আর তাঁকে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন। এবারের গণঅভ্যুত্থানের পর পরিস্থিতি বুঝে নারায়ণগঞ্জ থেকে শামীম ওসমান আরে কদফা হাওয়া হয়ে যান।
হলফনামায় সম্পদ
দশম সংসদ নির্বাচনের সময় শামীম ওসমানের জমা দেওয়া হলফনামার সঙ্গে দ্বাদশ সংসদের ভোটের হলফনামা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১০ বছরে তাঁর অস্থাবর সম্পত্তি তিন গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি ৯৮ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। যা আগে ছিল ২ কোটি ৪১ লাখ টাকার ৭৩ হাজার টাকা। এ সময়ে শামীম সাড়ে ১২ গুণের বেশি কৃষিজমির মালিক বনে যান। হয়েছেন পূর্বাচলে রাজউকের ১০ কাঠার প্লট আর দুটি টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার গাড়ির মালিক। তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল স্ত্রীর সম্পদও।
দশম সংসদ নির্বাচনে শামীম স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে নিজের নামে ১০ শতাংশ কৃষিজমি, ১৬ শতাংশ জমির ওপর ৭৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা মূল্যের দোতলা আবাসিক বাড়ি, উত্তরায় দেড় কোটি টাকা মূল্যের ৯ কাঠার জমি দেখিয়েছিলেন। তাঁর নিজের নামে ছিল ১০ তোলা সোনা।
২০২৪ সালের নির্বাচনী হলফনামায় স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে শামীম তাঁর নিজের নামে ১৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের ১২৩ শতাংশ কৃষিজমি, ১০ শতাংশ অকৃষিজমি, যার মূল্য ৫ হাজার ৭৫০ টাকা, ৩৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা মূল্যের পূর্বাচল রাজউক নিউ টাউনে ১০ কাঠার প্লট এবং ১৬ শতাংশ জমির ওপর ৭৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা মূল্যের দোতলা আবাসিক বাড়ি দেখান। এ সময় পর্যন্ত সোয়া ১২ গুণের বেশি কৃষিজমির মালিক হয়েছেন। তবে এসব স্থাবর সম্পত্তির মূল্য ২০১৪ সাল থেকে ২ শতাংশ কম দেখিয়েছেন।
১০ বছর আগে শামীমের নামে কোনো গাড়ি ছিল না। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় নিজের নামে দুটি গাড়ি দেখিয়েছেন তিনি। একটি ৫৬ লাখ ৯৩ হাজার টাকা মূল্যের টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার ভি-৮ গাড়ি, অন্যটি ৮১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা দামের টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার। এ ছাড়া একটি পিস্তল ও একটি রাইফেল দেখিয়েছেন। নিজের নামে ৩৮ তোলা সোনাসহ ২ কোটি ৪৯ লাখ টাকার এফডিআরসহ ৭ কোটি ৯৮ লাখ ৩ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পত্তি দেখিয়েছিলেন।
৪ হাজার কোটি টাকা পাচার
শামীম ওসমান, তাঁর ভাই সেলিম ওসমান, শামীমের ছেলে অয়ন ওসমান, স্ত্রী সালমা ওসমান লিপি, শ্যালক তানভীর আহমেদ টিটু, বড় ভাইয়ের স্ত্রী পারভীন ওসমান, ভাতিজা আজমেরী ওসমানসহ গোটা পরিবার হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, গত সাড়ে ১৫ বছরে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে শামীম ওসমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা।
শামীম নানাভাবে দুবাই, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে এই টাকা পাচার করেন। সেখানে বাড়ি, নাগরিকত্ব, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুই করেছেন শামীম ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। সূত্র জানায়, শামীম, তাঁর শ্যালক টিটু, ভাই সেলিম, বড় ভাবি পারভীন, ভাতিজা আজমেরীও দুবাইয়ে বাড়ি কিনেছেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আজমেরী ওসমান তাঁর স্ত্রী ও মাকে নিয়ে দুবাইয়ের বাড়িতে উঠেছেন। সেলিম ওসমানের বাড়ি রয়েছে মালয়েশিয়ায়। শামীমের বাড়ি রয়েছে তুরস্ক, কানাডার টরন্টো, দুবাইয়ে আজমান ও আমেরিকাতে। শামীমের শ্যালক টিটু পাঁচ থেকে ছয়টি বাড়ি কিনেছেন যুক্তরাষ্ট্রে।
সূত্র জানায়, পাচার করা এসব অর্থের মূল উৎস ছিল চাঁদাবাজি, মাদক কারবার, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, জমি দখলবাজি, পরিবহন ব্যবসা, ইন্টারনেট-ডিশ ব্যবসা, নৌপথে পণ্য পরিবহনের বেশ কয়েকটি বড় ট্যাঙ্কার জাহাজ। এসব অর্থ শামীমের বন্ধু ব্যাংক লিয়াকত, আরেক বন্ধু সাবেক ভ্যাট কর্মকর্তা অনুপ কুমার সাহা, শামীমের ক্যাডার শাহ নিজাম, কাউন্সিলর শাহজালাল বাদলসহ আরও বেশ কয়েকজনের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র।
নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি এবং সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি বলেন, ওসমান পরিবারের সদস্যরা হত্যা, চাঁদাবাজি, ভূমি দস্যুতাসহ এমন কোনো অপরাধ নেই, যা করেননি। তাদের সরাসরি আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা।
সাত খুন ও ত্বকী হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল। নারায়ণগঞ্জ থেকে একে একে আসে সাত ব্যক্তি অপহরণের খবর। এর তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠে সেই সাতজনের লাশ। দেশ তোলপাড় করা সেই হত্যাকাণ্ডে সন্দেহের আঙুল যায় র্যাবের দিকে। একে একে গ্রেপ্তার হন সংস্থাটির অভিযুক্ত কর্মকর্তারা। বিচার কার্যক্রম শেষে ঘোষণা করা হয় রায়ও। তবে আড়ালে রয়ে যান শামীম ওসমান। শামীমের তখনকার বিভিন্ন বক্তব্যের সূত্র ধরে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, পুলিশ, র্যাবসহ প্রশাসনের সবার ওপর ছিল শামীম ওসমানের প্রভাব। তাই সে সময় সন্দেহ করা হয়েছিল, শামীমের ইশারায় সাত খুন হয়েছিল কিনা।
নারায়ণগঞ্জে চাঞ্চল্যকর তানভীর মোহাম্মদ ত্বকী হত্যায় ওসমান পরিবারের সরাসরি সম্পৃক্ততার কথা অভিযোগ করে আসছিলেন ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি। তিনি গণমাধ্যমে অভিযোগ করে বলেন, ত্বকী হত্যায় শামীম ওসমান জড়িত। আর তা ঘটিয়েছে শামীমের ভাতিজা আজমেরী ওসমান।
১৬ খুনের আসামি, তবু দাপুটে ভাতিজা
জাতীয় পার্টির প্রয়াত সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের একমাত্র ছেলে আজমেরী ওসমান। শামীমের ভাতিজা আজমেরী অন্তত ১৬ হত্যার মামলার আসামি হয়েও নগর দাপিয়ে বেড়াতেন। আলোচিত ত্বকী হত্যার ঘটনায় র্যাব তাঁর বিরুদ্ধে খসড়া অভিযোগপত্র দিয়েছিল। তবে রাষ্ট্রীয় শীর্ষ পর্যায় থেকে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা থাকায় কখনও গ্রেপ্তার হননি আজমেরী।
এমনকি হত্যা মামলায় তাঁর নাম দিতে চাইলেও তা নেওয়া হতো না। ফলে বাধাহীনভাবে নারায়ণগঞ্জের আল্লামা ইকবাল রোডে টর্চারসেল বানিয়ে চালিয়েছেন নানা অত্যাচার-নিপীড়ন। জানা যায়, একের পর এক অপরাধ করে গেলেও বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি তাঁকে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন তিনি পালিয়েছেন।
ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময়ে আজমেরী ওসমানের বিরুদ্ধে নানা হত্যার অভিযোগের তদন্তের দাবি জানালেও প্রশাসন আমলে নেয়নি।’
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের ঢাকা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহবুবুর রহমান মাসুম বলেন, ‘আজমেরী নারায়ণগঞ্জে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করে, সে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে পারত। মানুষকে পুরো গুম এবং টুকরো টুকরো করে হত্যা করলেও কাগজপত্রে তার নাম আনা যেত না। প্রশাসন ছিল তাদের পকেটে। ত্বকী হত্যার পর নারায়ণগঞ্জে গণআন্দোলন গড়ে উঠলে সে সময় শেখ হাসিনা সংসদে ওসমান পরিবারকে রক্ষার কথা বলেন। ফলে আজমেরীর বিচারের বিরুদ্ধে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা তৈরি হয়।’
শামীমের টাকার গাছ ফতুল্লা স্টেডিয়াম!
ফতুল্লা স্টেডিয়াম হিসেবে পরিচিত স্টেডিয়াম প্রকল্পটির শুরুতে নাম ছিল ওসমানী স্টেডিয়াম-২। ১৯৯১-১৯৯৫ সালে বিএনপি আমলে অর্থ বরাদ্দ করে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই শামীম তাঁর প্রভাব খাটিয়ে স্টেডিয়ামের নাম বদলে তাঁর দাদা ‘খানসাহেব ওসমান আলী’র নাম দেওয়া হয়। শুরুতে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্ক রোডের চেয়ে ২ ফুট বেশি উচ্চতায় স্টেডিয়ামের মাঠ হওয়ার কথা থাকলেও স্টেডিয়ামে গড়ে ৬ ফুট কম বালু ভরাট করে সে টাকা আত্মসাৎ করেন শামীম। এর পর বছরের পর বছর এ স্টেডিয়াম ছিল ওসমান পরিবারের টাকার গাছ।
নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মাহবুবুর রহমান মাসুম ওসমানী স্টেডিয়ামের মাঠ সাইট কমিটির সদস্য ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যকরী সদস্য ছিলেন। তিনি বলেন, শুরুতে স্টেডিয়ামের বালু ফেলার জন্য বরাদ্দ করা টাকার অর্ধেকই শামীম ওসমান মেরে দেন। গত সাড়ে ১৫ বছর আর সর্বশেষ তিনশ কোটি টাকা বরাদ্দের বেশির ভাগ অংশ শামীম, তাঁর শ্যালক টিটুসহ তাদের সিন্ডিকেট লুটপাট করেছে।
রাজউকের জায়গা বেচে ৭৫ কোটি
শামীম প্রভাব খাটিয়ে নারায়ণগঞ্জে রাজউকের ৭৬ শতাংশ জমি বেচে দিয়ে হাতিয়ে নেন প্রায় ৭৫ কোটি টাকা। জমিটির মালিক সিটি করপোরেশন, এ নিয়ে মামলা রয়েছে– এত ভেজাল জেনেও পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক মোস্তাফিজুর রহমান বাজারদরের চেয়ে প্রায় অর্ধেক দামে জমি কিনতে শামীম ওসমানের সঙ্গে গাঁটছাড়া বেঁধেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ জমির অবস্থান নারায়ণগঞ্জ নগরের চাষাঢ়া বালুর মাঠ এলাকায় পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পেছনে। নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি রফিউর রাব্বি জানান, চাষাঢ়া বালুর মাঠের খালি প্লটগুলো রাজউকের। এ জমি নিয়ে মামলাও রয়েছে। মামলা চলমান থাকা অবস্থায় অধিগ্রহণ আইন না মেনে শামীমের প্রভাবে এ জমি বেচাকেনা হয়।
এ ব্যাপারে পপুলারের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমানের বক্তব্য জানতে পপুলারের নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার ধানমন্ডি অফিসে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। পপুলার নারায়ণগঞ্জের শাখা ব্যবস্থাপক শহীদুল ইসলাম স্বপন জানান, চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান দেশের বাইরে আছেন। আমরা শামীম ওসমানের কাছ থেকে কোনো জমি কিনিনি। জমি দখলে বা নির্মাণে তাঁর কোনো প্রভাবও খাটাইনি। আমরা নূপুর কুমার ভৌমিকের কাছ থেকে ৩৪ দশমিক ৬ কাঠা (প্রায় ৫২ শতাংশ) কিনেছি। কত টাকা দিয়ে কিনেছেন– এ প্রশ্নের উত্তর তিনি এড়িয়ে যান। তবে তাঁর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে রফিউর রাব্বি বলেন, ৫২ শতাংশ নয়, পুরো সাড়ে ৭৬ শতাংশ জমিই পপুলার কিনেছে।
ক্যাডার বাহিনীতে পদহীন নেতা
শামীমের কুকর্মে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের কোনো পদ-পদবি ছিলেন না। ‘সহজে টাকা কামানো যায়’– এ কারণে আওয়ামী লীগের পদের চাইতে শামীমের ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতিকেই বেশি পছন্দ করতেন অনেকে।
সর্বশেষ সিটি নির্বাচনে পেছন থেকে খেলেন শামীম। আওয়ামী লীগ সেই ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগের কমিটি ভেঙে দিলেও সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি। মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান রিয়াদ, ছাত্রলীগ নেতা রাফেল প্রধান, হিমেল খান, বিন্দু, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সাফায়াত আলম সানি, বন্দরের ক্যাডার খান মাসুদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জানে আলম বিপ্লব, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সাইফুদ্দিন আহম্মেদ দুলাল প্রধান, সিদ্ধিরগঞ্জ যুবলীগ নেতা মতিউর রহমান মতি, সিদ্ধিরগঞ্জ ছাত্রলীগ নেতা শাহজালাল বাদলসহ কয়েকশ ব্যক্তিকে পদের লোভ দেখিয়ে যত রকমের অপকর্ম করে সম্পদের পাহাড় চূড়ায় ওঠা যায়, তাই করেছেন।
শামীম ওসমান প্রসঙ্গে জেলা বিএনপির সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন বলেন, স্বৈরশাসকের চারণভূমি ছিল নারায়ণগঞ্জ। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান শেখ হাসিনার সমর্থনেই শামীম গডফাদার হয়েছিলেন। তাঁর বিশাল বাহিনী ছিল যারা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত থাকত। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ও তাঁর অস্ত্রের মহড়া নারায়ণগঞ্জবাসী দেখেছে। তাঁর কাছে নিজ দলের লোকজনও জিম্মি ছিল। বিষয়টি শেখ হাসিনাও জানতেন; কিন্তু শামীম ওসমানকে ব্যবহারের জন্য কেউ কিছু বলত না। বিএনপি নেতাকর্মীর ওপর সীমাহীন নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছেন শামীম। তিনি বলেন, শামীম এলাকায় কোনো উন্নয়নকাজ করতে পারেননি। আমরা শুধু শুনেছি, তিনি এ কাজ নিয়ে এসেছেন, সেই কাজ নিয়ে এসেছেন। কিন্তু আমরা কোনো উন্নয়ন দেখছি না। আমাদের ধারণা, যে বরাদ্দ এনেছেন, তা কাজ না করেই আত্মসাৎ করেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ২২:২৭:৩৮ ৫৭ বার পঠিত