কেরানীগঞ্জে একসময় যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাদের অনুমতি ছাড়া কেউ নতুন ভবন বা বাড়ি বানাতে পারতেন না। আর অনুমতি পাওয়ার পর ইট, পাথর, সিমেন্ট, বালু কিনতে হতো তাদের কাছ থেকে। এর বাইরে গেলেই নির্যাতনের শিকার হতে হতো। এলাকায় প্রকাশ্যে চাঁদাবাজিও করতেন ওই নেতারা। তবে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগের ওই নেতারা চলে গেছেন আত্মগোপনে।
রাজধানীর এই উপকণ্ঠের বাসিন্দারা জানান, কেরানীগঞ্জে কে কোথায় চাঁদাবাজি করবেন গত সরকারের আমলে তা ভাগ করা ছিল। একেক জায়গার নিয়ন্ত্রণ ছিল একেকজনের হাতে। যেমন– কদমতলীতে প্রভাবশালী ছিলেন ঢাকা জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও আগানগর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হাজি মো. রাসেল। একটি কিশোর গ্যাং চালাতেন তিনি। তাঁর গ্রুপে ছিলেন বাপ্পি, রিপন, রোমান শিকদার, শাওন, মিরাজ, সুমনসহ অন্তত ৪০ জন। চাঁদাবাজি করে বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক হওয়া রাসেলের চারটি বাড়ির তথ্য পাওয়া যায়।
জিম্মি করে নির্মাণসামগ্রী বিক্রি: ক্রেতা কোন দোকান থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনবেন, সেটি একান্তই তাঁর বিষয়। কিন্তু গত ১০/১২ বছর এ ক্ষেত্রে কেরানীগঞ্জের চিত্র ছিল ভিন্ন। যেকোনো দোকান থেকে নির্মাণসামগ্রী কিনতে পারতেন না ভবন নির্মাতা বা বাড়ির মালিক। স্থানীয় যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগের কিছু নেতা তাদের দোকান থেকে চড়া দামে নির্মাণসামগ্রী কিনতে বাধ্য করতেন। কথা না শুনলে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিতেন।
বাবুবাজার ব্রিজ থেকে কদমতলী প্রান্তে নামার পর ডানপাশে মডেল টাউন আবাসিক এলাকা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখানে নির্মাণসামগ্রী সরবরাহ করে দুটি চক্র। এর মধ্যে বড় চক্রটির নেতা ছিলেন হাজি মো. রাসেল। নিজের প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স একতা ট্রেডার্স’ থেকে নির্মাণসামগ্রী কিনতে বাধ্য করতেন তিনি। কামাল হোসেন নামে এক ব্যক্তি তাঁর এই ব্যবসা দেখভাল করতেন।
মডেল টাউনের আরেক অংশের নিয়ন্ত্রণ ছিল যুবলীগ নেতা নাজমুল ইসলাম শিশির, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জিনজিরা ইউপি সদস্য রমজান আলী, অভি হোসেন এবং রাগিব হাসান নেহালের হাতে। তাদের দোকানের নাম ব্রাদার্স ট্রেডার্স। স্থানীয়রা জানান, এই চক্রের বাইরে অন্য কারও কাছ থেকে নির্মাণসামগ্রী কেনার সুযোগ ছিল না। মডেল টাউনের বাড়ির মালিকেরা এ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে ভয় পান। নাম প্রকাশ না করে একজন বলেন, ‘৫ আগস্টের আগে রাসেল মেম্বারের দোকান ছাড়া কারও কাছ থেকে রড-সিমেন্ট কিনতে পারিনি।’
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে কদমতলী গিয়ে রাসেল মেম্বারকে পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তিনি পলাতক বলে জানান স্থানীয়রা।
প্রবাসীর ওপর হামলা: সাবান ফ্যাক্টরির মদিনানগর ৩ নম্বর গলিতে বছরখানেক আগে বাড়ি নির্মাণ শুরু করেন ইতালি প্রবাসী ইউসুফ মিয়া। এলাকার একটি দোকান থেকে তিনি নির্মাণসামগ্রী কেনেন। একদিন শুভাঢ্যা ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম সুইডেন, তাঁর ভাই আশিকুর রহমান নিডেন ও তাঁর সহযোগী ইমরান হোসেন টেনুর লোকজন ইউসুফের ওপর হামলা চালায়। ‘আল্লাহর দান এন্টারপ্রাইজ’ থেকে রড-সিমেন্ট না কেনায় তারা ইউসুফের ওপর হামলা চালায় বলে জানান স্থানীয় এক ব্যবসায়ী। ‘আল্লাহর দান’ দোকানের মালিক সুইডেন ও তাঁর কয়েক সহযোগী।
চক্রটি কলম ফ্যাক্টরি ও ইকবালনগর এলাকায়ও একইভাবে লোকজনকে জিম্মি করে ব্যবসা করে। ইকবালনগরে নির্মাণাধীন একটি ভবনের মালিক সোহরাব হোসেন বলেন, ‘বাড়ি করার পর এখানেই থাকতে হবে। তাই ঝামেলায় না গিয়ে তাদের কাছ থেকে সিমেন্ট, পাথর ও বালু কিনেছি।’ রেজাউল করিম সুইডেন গত ৫ আগস্টের পর থেকে পলাতক। অভিযোগের বিষয়ে চেষ্টা করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বাবা-ছেলের চাঁদাবাজি: বাবা ও ছেলে দু’জনই যুবলীগ নেতা। বাবা ইয়াছিন মিয়া দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা যুবলীগের সহসভাপতি, আর ছেলে মো. শামীম আগানগর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। স্থানীয়রা জানান, কদমতলী গোল চত্বরের কাছের অটোরিকশা স্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি করতেন এই বাবা-ছেলে। প্রতি অটোরিকশা থেকে দিনে নিতেন ৮০ টাকা করে।
ছেলে শামীমের বিরুদ্ধে ছিনতাইয়ের অভিযোগও রয়েছে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ছিনতাই করার সময় তিনি সহযোগীসহ র্যা বের হাতে ধরা পড়েছিলেন। সরকার পরিবর্তনের পর থেকে বাবা-ছেলে উভয়ই পলাতক।
এদিকে বন্দডাকপাড়া মহাসড়কের মুখের অটোরিকশা স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করতেন ঢাকা জেলা মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি আফজাল হোসেন ডিপটি। তাঁর হয়ে টাকা তুলতেন মো. হানিফ। প্রতি অটোরিকশা থেকে দৈনিক নিতেন ৭০ টাকা। পাশের প্রাইভেটকার স্ট্যান্ডে চাঁদা তুলতেন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা যুবলীগ নেতা আতাউর সরকার।
কমিউনিটি সেন্টার দখল: দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হিজলতলা-মাওয়া সড়কের পাশে মুক্তিযোদ্ধা জব্বার কমিউনিটি সেন্টারের কিছু জায়গা সড়কের জন্য অধিগ্রহণ করেছে সরকার। বাকি জায়গা দখল করে বাজার বসিয়েছেন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মিরাজুর রহমান সুমন। দুই শতাধিক দোকানের এই বাজার চলে ভোর ৬ থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত। প্রতি দোকান থেকে দৈনিক ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা চাঁদা নিতেন সুমনের লোকজন। বাজারের দোকানি আলম হোসেন বলেন, ‘শুধু দৈনিক চাঁদা নয়, সুমনকে অগ্রিম দিতে হয়েছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা।’ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে সুমন ও সহযোগীরা পলাতক।
আগানগর বাজার ছিল টিটুর নিয়ন্ত্রণে: কেরানীগঞ্জের আগানগর ব্রিজের নিচে সরকারি জায়গায় অবৈধভাবে বাজার বসিয়ে চাঁদা তুলতেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মীর আসাদ হোসেন টিটু। বাজারে দোকান রয়েছে আড়াই শতাধিক। দোকানপ্রতি তিন থেকে চার লাখ টাকা অগ্রিমও নিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া প্রতি দোকান থেকে মাসিক ভাড়া নিতেন ৪ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে মাসে অন্তত ২০ লাখ টাকা আদায় করতে তিনি। গত ৫ আগস্টের পর থেকে টিটুও আত্মগোপনে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩:৩৪:৪৫ ৯৮ বার পঠিত