রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ড. ইউনূসকে কটূক্তির অভিযোগে তৃতীয়পক্ষের মামলা, আইন কী বলছে?

প্রথম পাতা » জাতীয় » ড. ইউনূসকে কটূক্তির অভিযোগে তৃতীয়পক্ষের মামলা, আইন কী বলছে?
রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪



ড. ইউনূসকে কটূক্তির অভিযোগে তৃতীয়পক্ষের মামলা, আইন কী বলছে?

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে কটূক্তি করার ও হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে আরও একটি নালিশি মামলা করা হয়েছে। এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা সম্পর্কে ‘অশালীন মন্তব্যের’ অভিযোগে মোট দুইটি মামলা করা হলো।

আগে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক সরকারপ্রধান শেখ হাসিনাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানহানি করার অভিযোগে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরকে তার পক্ষ হয়ে মামলা করতে দেখা যেত। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ক্ষমতার পালাবদলের পর এখনও সেই প্রবণতা থামেনি।

মানহানির মামলা নিয়ে অতীতেও নানা ধরনের সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু তারপরও আদালতে বছরের পর বছর প্রত্যেক সরকারের আমলে এই ধরনের মামলাগুলো গৃহীত হয়েছে।

পেনাল কোডের ধারায় যেসব মানহানির মামলা হয়, সেসবের ক্ষেত্রে প্রায়ই এমন অভিযোগ শোনা যায় যে, একপক্ষ অপর পক্ষকে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে এগুলো করছে। মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে কটূক্তি ও তাকে হত্যার অভিযোগে পটুয়াখালীতে যে মামলা করা হয়েছে, সেখানেও একই বিষয় শোনা যাচ্ছে।

ড. ইঊনূসের মানহানি নিয়ে সর্বশেষ মামলাটি হয়েছে গত ২৬ সেপ্টেম্বর পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় উপজেলায়। জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আশীষ রায়ের আদালতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারা ও পেনাল কোডের ৩০৭, ৪৯৯, ৫০৬ (খ) ধারায় অভিযোগটি দায়ের করা হয়।

বিগত সরকারের আমলে অধ্যাপক ইউনূসের নামে যখন অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগে মামলা চলছিলো, তখন তাকে আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিতে হতো।

চলতি বছরের ২ মে তিনি একইভাবে হাজিরা শেষ করে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল সময় টিভি সে সময় মুহাম্মদ ইউনূসের সেই বক্তব্য সম্বলিত একটি ভিডিও তাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে পোস্ট করে। সেই পোস্টে মন্তব্য করেন আসামি মো. মাসুম বিল্লাহ।

আদালতে দায়ের করা অভিযোগে বলা হয়, আসামি সেই ভিডিওতে মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্দেশে মন্তব্য করে বলেছিলেন, ‘আপনাকে দেখে মনে হয় আমেরিকার দালাল।’

কিন্তু তার ওই মন্তব্যের কারণে ‘বাদীর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়’ বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।

বাদী দাবি করেছেন যে ফেসবুকে ওই মন্তব্যের পর আসামি ‘এলাকায় বসে মুহাম্মদ ইউনূসকে সুদখোর, ইহুদি পশ্চিমাদের দালাল বলে মানহানিকর বক্তব্য প্রকাশ করে’ এবং সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘একাকি পেলে গুলি করে হত্য’ করার হুমকি দিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) অভিযুক্ত মাসুম বিল্লাহ’র নামে মামলা দায়ের করার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘বাদী হাসান মাহমুদ আমার আপন চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। গ্রামের স্কুলের নিয়োগ সংক্রান্ত দ্বন্দ্বের জেরে আমাকে ঘায়েল করতে এমন কাল্পনিক ইস্যুতে মামলা দায়ের করেছেন।’

মাসুম বিল্লাহ’র বিরুদ্ধে বিতর্কিত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (বর্তমানের সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট)-এও অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিলো। এই আইনের অপব্যবহার নিয়ে বছরের পর বছর আলোচনা চলছেই।

যে কারও অভিযোগের ভিত্তিতে আদালতের এভাবে ‘মানহানির মামলা’ গ্রহণ করার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবী সারা হোসেন। তিনি মনে করেন, ‘অভিযোগে দুইটি কারণের কথা বলেছে, মানহানি ও হত্যার হুমকি। শুধুমাত্র মানহানির ব্যাপারে হলে কোনোভাবেই এটিকে তদন্তের জন্য পাঠানো উচিৎ ছিল না।’

কারণ, পেনাল কোডের ধারা অনুযায়ী, কেউ যদি কারও খ্যাতি নষ্ট করার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো শব্দ বা চিহ্ন বা প্রতীকের সাহায্যে নিন্দা প্রকাশ করে, তাহলে ওই ব্যক্তির মানহানি হয়েছে মর্মে গণ্য হবে। মৃত ব্যক্তির খ্যাতি বা সুনাম নষ্ট হয় এমন কোনো বক্তব্য দিলেও মানহানির মামলা হতে পারে।

এ বিষয়ে সারা হোসেন বলেন, ‘তৃতীয় পক্ষ যখন এরকম মানহানির মামলা করে, সেটি একেবারেই গ্রহণযোগ্য না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। যদি যার মানহানির অভিযোগ উঠানো হচ্ছে, উনি নিজে যদি অসুস্থ হন বা তার পক্ষে কোনো কারণে এটা করা সম্ভব না, তখন তৃতীয় পক্ষ এটা করতে পারে।’

এগুলোর বাইরে হলে ‘তৃতীয় পক্ষের এই মামলাগুলো নেওয়ার কোনো কারণই নাই’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি এও যোগ করেন, এই মামলার ক্ষেত্রে ‘আদালত ওই দুইটি বিষয়ই তদন্তের জন্য পাঠিয়েছে কি না, সেটা দেখার বিষয়। হত্যার হুমকির অভিযোগে পাঠালে ঠিক আছে।’

আদালত কেন মামলাগুলো নিচ্ছে

আইনজীবী সারা হোসেন বলেছেন, মানহানির বিষয়ে আইনটাও পরিষ্কার। তার মতে, ‘বিভিন্ন সরকারের আমলে এই আইনের সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। তারপরও আদালতগুলো যে এতদিন ধরে এই মামলাগুলো নিয়ে আসছে, এটাই সবার মনে বড় একটা প্রশ্ন জাগিয়ে দিয়েছে। আইনে বলা আছে, যারা পাবলিক ফিগার, তাদেরকে কিছু সমালোচনা নিতেই হবে। এত সহজে সবকিছুকে মানহানি বলা যাবে না।’

এ বিষয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খানের সাথেও।

তিনি মনে করেন, ‘আদালত এই মামলাগুলো নিচ্ছে, কারণ ৫৩ বছর ধরে রাষ্ট্রের নিয়ম এভাবেই চলে আসছে। এখন হয়তো আদালতের চেহারার, চেয়ারের, পদগুলোর পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু কাঠামোর কোনও পরিবর্তন হয়নি। ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি।’

এদিকে, পটুয়াখালীর ঘটনার আগে গত ২৪শে সেপ্টেম্বর ধর্মীয় অবমাননা এবং প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে কটূক্তির অভিযোগে সাইবার ট্রাইব্যুনাল চট্টগ্রামের আদালতে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইনে’ নালিশি মামলা হয়েছে।

ওই মামলার বিষয়েও আলাপ হয় আইনজীবী সারা হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের ঘটনায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা ও কটূক্তি, যদি দু’টো পয়েন্টেই যদি তদন্তে পাঠায়, তাহলে সেটাও ঠিক না।’

তিনি বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অপরাধে যদি পেনাল কোডে মামলা করতে চাইতো, তাহলে যে কেউ এরকম মামলা করতে পারতো না, অভিযোগ তুলতে পারতো। কারণ, পেনাল কোডে অভিযোগ করা হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে খোঁজখবর করে ঘটনার সত্যতা দেখা হয়। মন্ত্রণালয় অনুমতি দেওয়ার পরে মামলা করা যাবে।

সাইবার নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো এরকম একটা “রক্ষাকবচ” থাকা দরকার বলে মনে করেন তিনি।

বিদায়ী সরকারের সঙ্গে পার্থক্য কোথায়?

অল্প সময়ের ব্যবধানে দু’টো নালিশি মামলা হওয়ায় হতাশ হয়েছেন অনেকেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেকে লিখছেন যে বিগত সরকারের সময়ে মানুষ যেমন সরকারের সমালোচনা করার সাহস পেত না, পর পর এই দুই মামলাও সেই একই বিষয়কে ইঙ্গিত করছে যে- সমালোচনা করা যাবে না।

তবে এখানে দুই সরকারের মাঝে কিছুটা পার্থক্য আছে বলে মনে করেন আইনজীবী সারা হোসেন।

‘আগে হলে অভিযোগ জমা পড়ার সাথে সাথে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করা হতো। হয়তো পুলিশ অনেক সময় তদন্ত করতো না, আগেই গ্রেপ্তার করে ফেলত। এখানে এটা ভালো দিক যে তদন্তে পাঠিয়েছে।’

যদিও রাজনীতি বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান মনে করেন যে ক্ষমতা বা ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তি সম্পর্কে মানুষের ধারণা যতদিন না পাল্টাবে, ততদিন পর্যন্ত কোনোকিছুতে পরিবর্তন আসবে না, তা সে যে সরকার-ই ক্ষমতায় থাকুক না কেন। কারণে এখানে সমস্যা ‘মনজাগতিক ও সাংস্কৃতিক’।

‘একজন, দু’জন ব্যক্তি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সেই পরিবর্তন আনা সম্ভব না। চেয়ারের আর কী পরিবর্তন হবে? শেখ হাসিনার জায়গায় ড. ইউনূস এসেছে। ড. ইউনূসের বদলে আবার আরেকজন আসবেন। রাজনীতি রাজনীতির জায়গায় থেকে যাচ্ছে।’

২০২২ সালে ঢাকার রাস্তায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে প্রতিবাদের দৃশ্য।

সমাধান কোথায়?

রাশেদা রওনক খান মনে করেন যে, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করাটা সহজ না হলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি হবে না।

তিনি উন্নত বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের তুলনা করে বলেন, ‘আমেরিকা বা উন্নত দেশগুলোতে দেখি যে, হোয়াইট হাউসের সামনে দাঁড়িয়েও বিক্ষোভ করছে, বকাবকি করছে। সেজন্য কেউ কটূক্তির মামলা করছে না। কারণ, উন্নত দেশগুলোতে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করাটা একটি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের অংশ। তারা ওই জায়গাতে পৌঁছাতে পেরেছে, যা বাঙালি পারেনি। বাংলাদেশে একজন ক্ষমতাকে প্রশ্ন করলে আরেকজন আবার ক্ষমতার পক্ষ হয়ে অবমাননাকর মনে করে ক্ষমতাকে রক্ষা করতে নিজেই তার পক্ষে দাঁড়িয়ে যান।’

তবে এই সংস্কৃতি তখন-ই পরিবর্তন হতে পারে, যখন ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তি এই সমালোচনাকে সহজভাবে নিতে পারবেন এবং ‘জনসম্মুকে বলবেন যে আপনি সমালোচনা করতে পারবেন।’

এদিকে আইনজীবী সারা হোসেন মনে করেন যে ‘কালা কানুন’ খ্যাত সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টকে যদি ‘কোনোরকম রক্ষাকবচ বা সেফ গার্ড ছাড়া রেখে দেয়া হয়, তাহলে ঝুঁকি থেকেই যাবে।’

তিনি বলেন, ‘এই আইন যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ সমস্যা হবে। তাই আইনটা বাতিল করা উচিৎ। আমরা মানহানিসহ যেসব অপরাধের কথা বলছি, তা দণ্ডবিধির মাধ্যমেই বিচার করা যায়।’

অবশ্য বর্তমান বাস্তবতায় একটি সাইবার নিরাপত্তা আইন দরকার বলে মনে করছেন তিনি।

এই বিষয়ে জানতে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে মেসেজ ও ফোনকলে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাদেরকে পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ সময়: ১৩:১৫:২৮   ২৮ বার পঠিত