রবিবার, ২৮ জুলাই ২০২৪

সন্দেহ হলেই আটক মোবাইল ফোন ঘেঁটে দেখা হচ্ছে

প্রথম পাতা » জাতীয় » সন্দেহ হলেই আটক মোবাইল ফোন ঘেঁটে দেখা হচ্ছে
রবিবার, ২৮ জুলাই ২০২৪



রাজধানীর আরামবাগ মোড়ে পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি।

পরিবেশকর্মী মানিক হোসেন (৫০) জন্ম থেকেই বাস করেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বছিলায়। সেখানকার পরিবেশবিষয়ক যে কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায় তাঁকে। গত শুক্রবার ভোরে মানিককে বাসা থেকে নিয়ে যায় হাজারীবাগ থানা পুলিশ। পরিবারকে জানানো হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার সময় সিসিটিভি ফুটেজে মানিককে সড়কে দেখা গেছে।

পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের তৎপরতার পর মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন তথ্য যাচাই করে শুক্রবার সন্ধ্যায় মানিককে ছেড়ে দেয় পুলিশ। মানিক বলেন, ‘আমি কোনো আন্দোলনেই ছিলাম না। বাসার পাশে জরুরি প্রয়োজনে বের হয়েছিলাম। তখন হয়তো সিসিটিভির ভিডিওতে দেখা গেছে।’

মানিক হোসেনের মতো মোহাম্মদপুর ও বছিলা এলাকার অনেককে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে থানায় তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ১৮ থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত এ দুই এলাকায় ব্যাপক সহিংসতা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার পর এ স্পট ঘিরে পুলিশ ধরপাকড় চালাচ্ছে। বিভিন্ন বাড়ি এবং রাস্তায় মোবাইল ফোন ঘেঁটে দেখছে। আন্দোলনের ছবি কিংবা ভিডিও পেলেই আটক করা হচ্ছে।
পুলিশ অবশ্য বলছে, নিরপরাধ কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না। ঘটনাস্থল ও এর আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে শনাক্ত এবং তদন্তে প্রমাণ সাপেক্ষে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ফলে নিরপরাধ মানুষের আতঙ্কের কারণ নেই।

মোহাম্মদপুর ও বছিলা ছাড়াও রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া, রামপুরা-বাড্ডা, উত্তরা-আবদুল্লাহপুর এলাকায় ১৭ থেকে ২১ জুলাই ব্যাপক সংঘাত হয়। সারাদেশে এখন পর্যন্ত পুলিশ সদস্যসহ দুই শতাধিক মানুষের প্রাণ গেছে। তাদের অধিকাংশই ছিলেন বুলেটবিদ্ধ।

মোবাইল ফোনে ছবি থাকলে ধরা

তুরাগ থানায় একটি এবং উত্তরা পশ্চিম থানায় সহিংসতার অভিযোগে ১২টি মামলা করেছে পুলিশ। এসব মামলায় কারও নাম নেই।

প্রতিটি মামলায় অজ্ঞাত কয়েক হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। আটক ৮০ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এসব মামলায়।

আটক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগ কীসের ভিত্তিতে আনা হচ্ছে– এ প্রশ্নে এক কর্মকর্তা বলেন, দেখা হচ্ছে সেই সময়কার ছবি ও ভিডিওতে আটক ব্যক্তিকে দেখা গেছে কিনা। থাকলে গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। যাদের ছবি, ভিডিওতে দেখা গেছে, তাদেরই ধরা হচ্ছে। আটক ব্যক্তিদের অনেকে নিজেরাই লাঠি হাতে মিছিলে অংশ নেওয়া, ভাঙচুর করার ছবি তুলেছে, ভিডিও করেছে। এতে ওই ব্যক্তি ছাড়াও অন্যদের দেখা যাচ্ছে। এর মাধ্যমে শনাক্ত করা হচ্ছে। কেউ কেউ ছবি মুছে ফেলেছে। তা পুনরুদ্ধার করছে পুলিশ। কেউ কেউ ফোন ফ্যাক্টরি রিসেট দিয়ে ফেলেছে।
মোহাম্মদপুর আল্লাহ-করিম মসজিদের সামনে সবজি বিক্রেতা মো. রাকিব হোসেনকেও (২২) তাঁর বাসা থেকে ধরা হয়। তাঁর মেসের রুমমেট নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বাড়ি ভোলার চরফ্যাসন। মোহাম্মদপুর চাঁদ উদ্যানে থাকি। ভ্যানে সবজি বিক্রি করি। ১৮ জুলাই আন্দোলনের সময় অন্যদের মতো কৌতূহলবশত রাকিবও ফোনে বিক্ষোভের কিছু ঘটনার ভিডিও করেন। ২২ জুলাই রাতে মেসে পুলিশ অভিযান চালায়। সবার ফোন ঘেঁটে দেখে। তিনজনের ফোনে আন্দোলনের ভিডিও পায়। দু’জনকে অন্যদের জিম্মায় রেখে গেলেও রাকিবকে নিয়ে যায়। সংঘর্ষের মামলায় তাঁকে জেলে পাঠানো হয়েছে।’
পাড়া-মহল্লার কারা কারা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল– এ তথ্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর কাছ থেকেও পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন উত্তরা জোনের আরেক পুলিশ কর্মকর্তা।

সংঘর্ষের সময়ে হামলা হয়েছিল উত্তরা পূর্ব থানায়। এ থানার অধীন এলাকাতেই সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয়েছে। তবে কত মামলা হয়েছে, তা জানা যায়নি। গতকাল শনিবার থানায় গিয়ে সহকারী কমিশনার, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং অন্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। অন্যরা ধারণা দিলেন, মামলার সংখ্যা ২০টির বেশি। একজন উপপরিদর্শক জানান, একটি মামলায় ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছেন। যাচাই-বাছাই করার সুযোগ পাননি। সবাইকে আদালতে চালান দিয়েছেন।

সিসিটিভিতে দেখা গেলেও রেহাই নেই

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বছিলা ওয়েস্ট ধানমন্ডি হাউজিংয়ের এক বাসিন্দা বলেন, অনেকেই আন্দোলন দেখতে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। বিভিন্ন ভবনের দোকানের সিসিটিভি ফুটেজে তাদের দেখা যাচ্ছে। শুধু এক কারণেই এখন ধরা হচ্ছে।

মো. হাসান মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজারের একটি জুস কোম্পানিতে চাকরি করেন। তাঁকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের আল্লাহ-করিম মসজিদের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। হাসানের ফুফু শিরিন বেগম বলেন, ‘আমার ভাতিজা কোনো দোষ করেনি। তারে ধইরা আনছে।’

কাঠপট্টি এলাকায় বাসার সামনে থেকে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র নাঈম হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। নাঈমের মামা মো. স্বপন বলেন, ‘ছেলেটির বয়স মাত্র ১৩। সে তো আন্দোলনই বুঝে না।’

১৪ বছরের সজীব কাজ করত মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারের মুরগির দোকানে। গত ২২ জুলাই রাত ১০টার দিকে তাকেও নিয়ে যায় পুলিশ। সজীবের বড় ভাই মো. শাহীন বলেন, ‘আমার ভাই পড়ালেখা করে না। ও আন্দোলন করবে কেন? আমার সুস্থ ভাইকে রাতে ধরে এনে নির্যাতন করা হয়েছে। সকালে ওকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেয় পুলিশ। সেখান থেকেই সকাল সাড়ে ১০টার দিকে থানায় আনা হয়েছে। থানায় ঢোকার সময় আমার ভাইকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখেছি। ওর হাতেও জখম রয়েছে।’

মোহাম্মদপুর বাঁশবাড়ি থেকে অন্তর (১৭), তুহিনকে (২০) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মামা রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালসে কর্মরত মো. রাজু বলেন, ‘অন্তর শাহবাগে রেস্টুরেন্টে কাজ করে। তুহিন চাকরি করেন মোহাম্মদপুর টোকিও স্কয়ারে। বাসায় যাওয়ার পথে তাদের পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। যারা অন্যায় করেছে ঠিকই পালিয়ে গেছে। এখন সাধারণ মানুষকে ঝামেলায় ফেলা হচ্ছে।’

মামলার পর মামলা, আসামি বেশুমার

গতকাল বাড্ডায় সাতটি, রামপুরায় চারটি ও খিলগাঁও থানায় পাঁচটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় দুপুর পর্যন্ত ১৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাড্ডা ও রামপুরা থানা এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন, ফোনে আন্দোলনের ছবি থাকলেই ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার বাড্ডা থানায় গিয়ে দেখা যায়, নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ জোরদার। সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন থানার পুলিশ সদস্যরা। সেবাপ্রার্থীর তেমন ভিড় নেই। কয়েকজনকে সাধারণ জিডি করতে

দেখা যায়।
ওসি মোহাম্মদ ইয়াসীন গাজী জানান, বাড্ডা থানার সাত মামলার পাঁচটির বাদী পুলিশ। সাধারণ মানুষ বাদী হয়েছেন দুটি মামলার। এসব মামলায় ১২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযান অব্যাহত আছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে ও তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে নিশ্চিত হওয়ার পর জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

ওসি জানান, আন্দোলনকারীরা একাধিকবার বাড্ডা থানায় হামলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পুলিশের বাধায় পারেনি। আফতাবনগর গেটের পুলিশ ফাঁড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ফাঁড়ির সবকিছু পুড়ে গেছে। ফাঁড়ির ইনচার্জসহ ২১ পুলিশ সদস্য আহত হন। এখনও চারজন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

সরেজমিন স্থানীয় বাসিন্দা, বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও পুলিশের সঙ্গে কথা হয়। তাদের ভাষ্য, ১৮ জুলাই সকাল ৯টার দিকে মেরুল বাড্ডায় প্রথমে রাস্তায় নামেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এর পর আধাঘণ্টার মধ্যে আশপাশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যুক্ত হন। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে গেলে সংঘর্ষ শুরু হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, সংঘর্ষের সময় সড়কে বা আশপাশে সিসিটিভি ফুটেজে যাদের দেখা যাচ্ছে, তাদের নির্বিচারে ধরছে পুলিশ।

গতকাল দুপুরে রামপুরা থানায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ১৯ জুলাই এ থানায় হামলা হয়েছিল। তবে রামপুরা থানায় হামলার মামলা হয়েছে খিলগাঁও থানায়। কারণ থানা ভবনটি খিলগাঁও থানা এলাকার মধ্যে পড়েছে।

খিলগাঁওয়ের ওসি সালাউদ্দিন মিয়া জানান, এক পুলিশ পরিদর্শককে হত্যাসহ পাঁচটি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তারের সংখ্যা ৩০। রামপুরা থানার ওসি মশিউর রহমান বলেন, চার মামলায় ৩৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এদিকে গতকাল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানা কম্পাউন্ড এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। আটক কোনো ব্যক্তিও থানাহাজতে নেই। দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের আইজি, ডিএমপি কমিশনারসহ পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তারা যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া এলাকা পরিদর্শনে যান। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্বাগত জানান। এ সময় এক পুলিশ সদস্য দূর থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এতদিন তাণ্ডবের সময় কোনো আওয়ামী লীগকে পাওয়া গেল না। এখন এসেছে মিছিল নিয়ে।’
কদমতলী থানায় আটক কাউকে থানা হাজতে পাওয়া যায়নি। থানার দু’পাশে পুলিশ সদস্যরা বেঞ্চ পেতে বসে আছেন। সাধারণ মানুষের কোনো যাতায়াতও থানায় দেখা যায়নি। থানার কর্মকর্তারাও ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের প্রটোকলে ব্যস্ত। দুটি থানা থেকেই ডিউটি অফিসাররা জানান, আন্দোলনকেন্দ্রিক মামলা-সংক্রান্ত তথ্য ডিএমপির জনসংযোগ বিভাগ থেকে সরবরাহ করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩:২০:৩৩   ৪৪ বার পঠিত