রাজধানীর শনির আখড়া এলাকার সহিংস পরিস্থিতি গভীর রাতেও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বুধবার দিবাগত মধ্যরাতেও সড়কে আন্দোলনকারীদের অবস্থান করতে দেখা গেছে। এতে এদিন সকাল ১০টার পর থেকে ১৫ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। রাতে শনির আখড়ার কাজলা থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, অন্তত ২০টি জায়গায় আগুন ধরিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। এ ছাড়া সড়কের বিভিন্ন জায়গায় গাছের গুঁড়ি ও ইট ছড়িয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
রাত সাড়ে ১২টার দিকে শনির আখড়ার কাজলা থেকে রায়েরবাগ হয়ে সাইনবোর্ড পর্যন্ত সড়কে আন্দোলনকারীরা অবস্থান করছিলেন। অপরদিকে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে বিপুলসংখ্যক র্যাব, পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্য সতর্ক অবস্থানে ছিলেন। কিছুক্ষণ পরপর আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে থাকেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। পুলিশ যখনই আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেয়, তখন তাঁরা সড়কের গলিতে দৌড়ে আশ্রয় নেন।
সন্ধ্যার পর থেকেই দুই পক্ষের মধ্যে এই অবস্থা চলছিল। এ সময়ে শুধু অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া ওই সড়কে আর কোনো যানবাহন চলছিল না। তাতে ঢাকায় প্রবেশের গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কে অনেকটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়।
গভীর রাতে রায়েরবাগে সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা রিকশাচালক শাহাবুদ্দিন মাঝির সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘বহু দিন আমি শনির আখড়া-রায়েরবাগ এলাকায় রিকশা চালাই। কিন্তু এমন ভুতুড়ে সড়ক কোনো দিন দেখি নাই। সকাল থেকে এ রাস্তা দিয়ে কোনো গাড়ি চলছে না। আর সন্ধ্যার পর সড়কে কেবল আগুন।’
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে শরিক হয়ে শনির আখড়ার দনিয়া কলেজের শিক্ষার্থীসহ যাত্রাবাড়ীর স্থানীয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা বুধবার সকাল ১০টায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন। তখন থেকে দেশের ব্যস্ত এই মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দিনভর এমন অবস্থা চলায় সড়কে যানজট দেখা যায়। সন্ধ্যার দিকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের সময় পুলিশের শটগানের গুলিতে আহত ছয়জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। তখন থেকে বদলে যেতে থাকে শনির আখড়া থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত সড়কের চিত্র। আন্দোলনকারীরা মেয়র হানিফ উড়ালসড়কের কাজলা অংশের টোল প্লাজায় আগুন ধরিয়ে দেন।
পরে ছত্রভঙ্গ করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ধাওয়া দিলে আন্দোলনকারীরা পিছু হটেন। আবার তাঁরা এক জোট হয়ে পাল্টা ধাওয়া দিতে থাকেন। একপর্যায়ে শনির আখড়ার কাজলা থেকে রায়েরবাগ পর্যন্ত সড়কের দুই পাশের দোকানপাট ভয়ে বন্ধ করে দেন দোকানদারেরা।
এই পরিস্থিতি চলার মধ্যে রাত ৯টার দিকে যাত্রাবাড়ী থানার প্রধান ফটকের সামনে গিয়ে বিপুলসংখ্যক র্যাব সদস্যকে সতর্ক অবস্থানে দেখা যায়। পাশাপাশি সেখানে এপিবিএনের অনেক সদস্য ছিলেন।
এ সময় যাত্রাবাড়ী থানার অদূরে মাছের আড়তের সামনের সড়কে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের বিপুলসংখ্যক সদস্য আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেন। কিছুক্ষণ পরপর পুলিশের শটগান থেকে গুলি ছোড়ার আওয়াজ শোনা যায়। যাত্রাবাড়ী থানার সামনে উপস্থিত অন্তত পাঁচজন পুলিশ সদস্য এই প্রতিবেদককে জানান, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সন্ধ্যার পর থেকে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলছে। আন্দোলনকারীরা অবস্থান নিয়ে আছেন কাজলা এলাকায়।
রাত সাড়ে ৯টার পর বিকল্প সড়ক দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজলা অংশে গিয়ে দেখা যায়, শতাধিক আন্দোলনকারী সড়কে অবস্থান নিয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগের হাতে লাঠি। সড়কের শনির আখড়া ও কাজলার মধ্যবর্তী স্থানে অন্তত পাঁচটি জায়গায় আগুন জ্বলছে। কাজলা থেকে মূল সড়ক ধরে শনির আখড়া অংশে যাওয়ার সময় দেখা যায়, সড়কে ছড়িয়ে রয়েছে ইটপাটকেল, গাছের গুঁড়ি। শনির আখড়ার সড়ক ধরে রায়েরবাগ পর্যন্ত একই চিত্র। সড়কের দুই পাশে আগুন জ্বলছে। সেখানে অবস্থান নিয়ে রয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
রাত সাড়ে ১১টায় রায়েরবাগ উড়াল পদচারী–সেতুর নিচে একদল আন্দোলনকারীকে স্লোগান দিতে দেখা যায়। এর কিছুটা দূরেও সড়কে আগুন জ্বলছিল।
সরেজমিনে দেখা গেছে, আন্দোলনকারীরা কেবল মহাসড়কের ওপর আগুন ধরাননি, তাঁরা শনির আখড়া থেকে রায়েরবাগের গলির সড়কেও আগুন ধরিয়ে দেন। এসব সড়কেও যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে সকাল থেকে সাইনবোর্ড থেকে মানুষজন হেঁটে হেঁটে যাত্রাবাড়ীতে পৌঁছান।
তাসলিমা খাতুন নামের এক নারী রাত ১২টার দিকে সাইনবোর্ড থেকে হেঁটে যাত্রাবাড়ীতে পৌঁছান। তিনি বলেন, ‘আমি এসেছি কুমিল্লা থেকে। সাইনবোর্ডে নামিয়ে দেওয়ার পর কোনো গাড়ি পাইনি। অনেকক্ষণ সেখানে বসে ছিলাম। পরে বাধ্য হয়ে মধ্যরাতে হেঁটে যাত্রাবাড়ী যাচ্ছি।’
আটকে আছে শত শত গাড়ি
এই সংঘর্ষের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে শত শত যানবাহন আটকা পড়েছে। রাত সাড়ে ১২টার দিকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় মহাসড়কে যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখা যায়। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন ওই যানবাহনগুলোর যাত্রী ও চালকেরা।
নোয়াখালী-ঢাকা রুটে চলাচলকারী হিমাচল পরিবহনের যাত্রী মো. রাব্বি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি বলেন, সোমবার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। বুধবার রাত আটটার দিকে এই গাড়িতে করে রাজধানীর উদ্দেশে রওনা দেন। কিন্তু দুই ঘণ্টা যাবৎ সাইনবোর্ডে আটকে আছে তাঁর বাস।
চট্টগ্রাম থেকে বিকেল পাঁচটার দিকে রওনা দিয়ে রাত ১০টার দিকে সাইনবোর্ড এলাকায় আসেন আর কে এন্টারপ্রাইজের কাভার্ড ভ্যানের চালক রুবেল মিয়া। তিনি বলেন, তাঁর গাড়িটি মতিঝিল যাবে। দুই ঘণ্টা ধরে যানজটে আটকে আছেন। গাড়িতে মালামাল রয়েছে। তাই রাস্তায় যত ঝামেলা থাকুক না কেন, ঝুঁকি নিয়েই গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে।
আনোয়ার সিমেন্ট কোম্পানির গাড়িরচালক নাজির হোসেন বলেন, শনির আখড়ায় গাড়ি ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনায় কোনো গাড়ি সামনের দিকে যেতে পারছে না। কখন পুরান ঢাকার কদমতলীতে পৌঁছাবেন, তা-ও জানেন না। ভাঙচুর ও আগুনের ঘটনায় আতঙ্ক তো আছেই।
বাংলাদেশ সময়: ৩:২৪:৩১ ৬৮ বার পঠিত