শুক্রবার, ১২ জুলাই ২০২৪

পিএসসির কর্মচারীর কাছে ১০ কোটি টাকার চেক

প্রথম পাতা » অপরাধ » পিএসসির কর্মচারীর কাছে ১০ কোটি টাকার চেক
শুক্রবার, ১২ জুলাই ২০২৪



পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম।

কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে আসছে সাপ। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসে আরও কয়েকজনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাদের মধ্যে অন্তত দু’জন পিএসসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তারা পদমর্যাদায় উপপরিচালক (ডিডি) ও সহকারী পরিচালকের (এডি) ওপরে।

তবে তথ্য-প্রমাণসহ আইনের আওতায় না আনা পর্যন্ত ওই দু’জনের নাম-পরিচয় প্রকাশে রাজি হননি তদন্তসংশ্লিষ্ট এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তবে গ্রেপ্তার কয়েকজনের সঙ্গে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে তাদের তথ্য আদান-প্রদানের কিছু তথ্য গোয়েন্দারা পেয়েছে।

এদিকে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলামের কাছে ১০ কোটি টাকার চেক পাওয়া গেছে। চাকরিপ্রত্যাশীদের যারা চেক দিয়েছেন, তাদের তালিকা এখন গোয়েন্দাদের হাতে। জিজ্ঞাসাবাদে সাজেদুল স্বীকার করেছেন, চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতেই এসব চেক নেওয়া হয়। গতকাল বুধবার একটি দায়িত্বশীল সূত্র এসব তথ্য জানায়।

নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় এখন পর্যন্ত সিআইডি পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম, খলিলুর রহমানসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। সাজেদুলের বাড়ি নোয়াখালীর চরজব্বারের মধ্য চরবাটায়। পরীক্ষার আগে থেকেই সাজেদুল ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মাধ্যমে চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। টাকার দেনদরবারও হতো আগেভাগে এবং ব্যাটেবলে হলে সাজেদুল অগ্রিম চেক নিয়ে রাখতেন। এখন পর্যন্ত তাঁর কাছ থেকে ১০ কোটি টাকার চেক পাওয়া গেছে। এ ছাড়া সিআইডির অভিযানে এখন পর্যন্ত ৭১ লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছে। এই চক্র আরও ৩০টি সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে বলে জানিয়েছে সিআইডি।

সূত্র জানায়, পরীক্ষার আগে সাজেদুল চাকরিপ্রার্থীদের ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ভাড়া বাসা এবং মেসে জড়ো করতেন।

পরীক্ষা শুরুর আগেই গোপনে সমাধানসহ হুবহু প্রশ্ন দিতেন। যেসব বাসা-মেস তিনি এ অপকর্মে ব্যবহার করতেন, সেগুলোকে ‘বুথ’ বলা হয়। রাজধানীর রামপুরা ও খিলগাঁওয়ে এ ধরনের চার-পাঁচটি বুথের সন্ধান মিলেছে। এ চক্রের আরেক বুথ ছিল পল্টনের কালভার্ট রোডে। এ ছাড়া আবেদ আলী সাভারের রেডিও কলোনিতে কক্ষ ভাড়া নিয়ে ফাঁস করা প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করানোর ব্যবস্থা করেন।

সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, দুই দশকের বেশি পিএসসির সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত। তাঁর চক্রে অনেকেই আছেন। আবেদ এক সময় পিএসসির আলোচিত সদস্য অধ্যাপক মাহফুজুর রহমানের গাড়ি চালাতেন। আবেদ ও সাজেদুল জিজ্ঞাসাবাদে একেক সময় একেক তথ্য দিচ্ছেন। সাজেদুল কখনও দাবি করছেন, চক্রের ‘হোতা’ পিএসসির উপপরিচালক আবু জাফর। তিনি মূলত জাফরের মাধ্যমেই প্রশ্ন পেতেন। চাকরি পাওয়ার পর কেউ যাতে টাকা নিয়ে নয়ছয় করতে না পারে, সে জন্য অগ্রিম চেক রাখতেন।

তিনি বলেন, চাকরির আশায় বিভিন্ন অঙ্কের চেক দেওয়া ৬০-৭০ জনের নাম-পরিচয় পেয়েছে গোয়েন্দারা। আরও অনেককে খোঁজা হচ্ছে। তদন্তের অংশ হিসেবে আরও অনেককে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যে পিএসসিতে কর্মরত দু’জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আছেন। তারা যাতে পালাতে না পারেন, সে ব্যাপারে নেওয়া হয়েছে বেশ কিছু পদক্ষেপ। তবে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি সামনে আসার পর মোবাইল ফোন বন্ধ করে তারা ‘গা-ঢাকা’ দিয়েছেন।

সিআইডি সূত্র জানায়, প্রশ্ন ফাঁসে জড়িতদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের খোঁজ নেওয়া শুরু হয়েছে। কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন ফাঁস করে হঠাৎ তারা বিপুল বিত্তের মালিক হয়েছেন, বিশদ জানার চেষ্টা চলছে। জড়িতদের ব্যাংক লেনদেনের তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এ ছাড়া স্বজনের কেউ অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জন করলে, তাঁকেও আইনের আওতায় এনে তদন্ত করা হবে। পিএসসির দুই কর্মকর্তার ব্যাংক হিসাবে গত তিন মাসে ২০ কোটি টাকার বেশি লেনদেনের তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা।

প্রশ্ন ফাঁসে গ্রেপ্তারদের মধ্যে ছয়জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের মধ্যে অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান জানান, পিএসসির সাবেক এক কর্মকর্তাও প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত। তিনি ‘সবুজ সংকেত’ দিলেই শুধু অর্থ লেনদেনের বিষয় চূড়ান্ত হতো। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়ামুলও প্রশ্ন ফাঁসে নানা সময় তাঁকে সহযোগিতা করতেন। ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষায় ১০ চাকরিপ্রত্যাশীর কাছে এ চক্রের মাধ্যমে প্রশ্ন গেছে। তাদের মধ্যে ছয়জন লিখিত পরীক্ষায় পাস করেন। মৌখিক পরীক্ষায় তিনজন বাদ পড়লেও, বাকিরা চাকরি করছেন।
আদালতে জবানবন্দিতে সাজেদুল বলেন, রেলওয়ের উপসহকারী প্রকোশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন পিএসসির এক সদস্যের কক্ষে থাকা ট্রাঙ্ক থেকে সংগ্রহ করেন। ওই প্রশ্ন তিনি আবেদ আলী ও খলিলুর রহমানের কাছে ৭৫ লাখ টাকায় বিক্রি করেছিলেন।

জানা যায়, প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত আবেদ আলী ৫০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক। বাবার অবৈধ টাকায় বিলাসী জীবনযাপন করতেন ছেলে সদ্য বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম। আবেদের বাড়ি মাদারীপুরের ডাসার পশ্চিম বোতলা গ্রামে। হঠাৎ করে তিনি ডাসার উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনের ঘোষণা দিলে চাঞ্চল্য দেখা দেয়। এর পর তাঁর ছেলে সিয়াম ডাসার উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি পদ বাগিয়ে নেন। টাকা দিয়ে জেলা ছাত্রলীগের নেতাদের ম্যানেজ করে পদ পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

প্রশ্ন ফাঁস মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির সাইবার ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন্স বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের সংঘবদ্ধ চক্রের অনেকেই নজরদারিতে। তাদের কারও অবৈধ সম্পদ পাওয়া গেলে অনুসন্ধান করা হবে। প্রয়োজনে মানি লন্ডারিং মামলায় তারা আসামি হবেন। পুরো প্রক্রিয়ায় জড়িতদের মাধ্যমে বিষয়টি নিরূপণ করা হচ্ছে।

তদন্ত করতে দুদকে চিঠি

প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় পাঁচজনকে বরখাস্ত করেছে পিএসসি। তারা হলেন– উপপরিচালক মো. আবু জাফর, জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক আলমগীর কবীর, অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম ও খলিলুর রহমান। এই পাঁচজনের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে বুধবার দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চিঠি দিয়েছে পিএসসি।

বাংলাদেশ সময়: ১৯:০৭:৩৯   ১০১ বার পঠিত