সাবেক এটর্নী জেনারেল ও সুপ্রীম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন খন্দকার (এম এইচ খন্দকার) এর সন্তান আব্দুল জামিল মোহাম্মদ আলী (এ জে মোহাম্মদ আলী) ও ছিলেন এটর্নী জেনারেল এবং সুপ্রীম কোর্ট বারের সভাপতি এবং সুপ্রীম কোর্টের ইতিহাসে এর রকমটা বিরল। চেম্বারে থেকে স্যার সম্পর্কে অনেক বিষয়ে জেনেছি স্যারের অত্যন্ত বিশ^স্ত ক্লার্ক জনাব আবিদুর রহমানের কাছ থেকে এবং স্যারকে যেভাবে দেখেছি উহার কিছু কিছু পাঠকের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করব।
স্যারকে যখন অতিরিক্ত এটর্নী জেনারেল হিাসাবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্রস্তাব করা হলো, স্যার নাকি তখন মুখের উপর না করে দিয়েছিল। কারণটা ছিল সেই সময়ে যাকে এটর্নী জেনারেল হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, স্যার তাঁর চেয়ে ১ বছর পূর্বে আপীল বিভাগের সিনিয়র এডভোকেট হিসেবে তালিকাভ‚ক্ত হয়েছিলেন। তারপরে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ও আইন অঙ্গনের বেশ কিছু ব্যক্তিবর্গ এ বিষয় নিয়ে স্যারের মাকে রাজি করান এবং সারের মায়ের অনুরোধেই তৎকালীন সময়ে অতিরিক্ত এটর্নী জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে ২০০৫ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে ২০০৭ সালের ২৪ জানুয়ারী পর্যন্ত বাংলাদেশের এটর্নী জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
স্যারকে বলা হতো সিভিল মামলার মাস্টার অব ফ্যাক্টস। বর্তমান সময়ে যে ক’জন সিভিলের দক্ষ আইনজীবী হিসেবে গন্য করা হয়, স্যার ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। স্যার যখনই কোন মামলা শুনানী করতেন, বিচারক থেকে শুরু করে সমস্ত আইনজীবীরাই মন্ত্র-মুগ্ধের মতো শুনতেন এবং তিনি বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে মামলার বিষয় বস্তুকে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলতেন এবং বিষয়ে তিনি ছিলেন অতুলনীয়।
স্যারের কাছে কোন বিষয়ে আইনী মতামত চাওয়া হলে, স্যার সেই বিষয়ে নিজে হাতে লিখতেন। একবার একবার একটি তৃপক্ষীয় চুক্তি সম্পর্কে মতামত লিখে আমাকে ডেকে টাইপ করতে বললেন। দেখলাম কোন পাতাতেই কোন কাটাকাটি নেই, একদম ফ্রেশ লেখা এবং স্যার বললেন হুবহু টাইপ করতে, যেন কোন ভুল না হয়। আমিও দারি, কমা থেকে শুরু করে হুবহু টাইপ করে স্যারকে দিলাম। স্যার একবার পরার পরে নিচে স্বাক্ষর করে সেটাকে একটা খামে করে দিতে বললেন। আমি অবাক হলাম এই ভেবে যে- একবারেই ফাইনাল! আমার বেশ কিছু আইনজ্ঞের সাথে কাজ করার সুয়োগ হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো সাবেক বিচারপতি জনাব মোঃ হামিদুল হক স্যার। তিনিও ছিলেন অসম্ভব পন্ডিত ছিলেন। কিন্তু তিনি একবার লিখতেন এর পরে কয়েকবার কারেকশান করার পরে ফাইনাল করতেন। কিন্তু, এ জে মোহাম্মদ আলী স্যারের ভিতর থেকে একবারেই ফাইনালটা বের হতো এবং স্যারের আইনী লেখনী ছিল অত্যন্ত উঁচু মানের এবং ছন্দময়ী।
স্যার ছিলেন প্রচারবিমুখ একজন মানুষ এবং ভীষন নীতিবান। একবার এপিলেট ডিভিশনে এক মামলায় স্যার একপক্ষে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন। মামলায় পক্ষ ছিলেন অনেকজন। অপর পক্ষের আরেকজন সিনিয়র এডভোকেট যিনি কয়েকজন পিটিশনারের পক্ষে এবং কতেক রেসপন্ডেন্টের পক্ষে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন। যখনই বিষয়টি স্যারের নজরে আসলো সাথে সাথে কোর্টে মেনশন করে বললেন মাই লর্ডস আমার অপর পক্ষের ফ্রেন্ডস, দুই পক্ষেই নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি কোন পক্ষে মামলা পরিচালনা করবেন, আগে সেটা ঠিক করতে হবে, তারপর আমি শুনানী করবো, অন্যথায় আমি এ মামলা শুনানী করবো না। এটা শোনার সাথে সাথে আদালত কক্ষে হাশির রোল পরে গেল।
টেলিভিশনের ক্যামেরা দেখলে তিনি সেটাকে এ্যাভোয়েড করতেন। সব সময়ই বলতেন, মিডিয়ায় নিজেকে দেখিয়ে প্রচার করার ক্ষেত্রে স্বর্থকতার কিছু নেই। টেলিভিশনে মুখ দেখিয়ে বড় আইনজীবী হওয়ার কি আছে!
গত মার্চ মাসে একটা ঘটনা এবং ওটাই ছিল স্যারের সাথে সর্বশেষ উপস্থিত থাকা। একটি সিভিল মামলা পরিচালনার জন্য স্যারকে সিনিয়র এ্যাংগেজ করলেন। কেসটা ছিল এ রকম যে, এক লোকের ছিল দুই স্ত্রী। দ্বিতীয় ঘরের বড় ছেলে বাবা এবং সৎ মাকে পাগল ঘোষনা চেয়ে মামলা করেছেন। ইহাতে এ বড় ছেলে নি¤œ আদালতে হারার পরে হাইকোর্টে আসলে স্যার বাবা-মায়ের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন এবং প্রথম স্ত্রী, অর্থাৎ ঐ ছেলের সৎ মা হাইকোর্টে এসে বললেন স্যার আমি পাগল না। আমাকে আপনি বিভিন্ন প্রশ্ন করেও দেখতে পারেন- আমি পাগল না। আমাদেরকে পাগল দেখিয়ে সম্পদ নিয়ে যাওয়ার জন্যই এই ছেলেটি এই মামলাটি করছে। বিষয়টি শুনে বিচারক নিজেই অবাক হলেন এবং মামলাটি শুনানীর এক পর্যায়ে পোডিয়ামে দারিয়ে স্যার কেঁদেই দিলেন এবং অনেকক্ষন কাঁদলেন এই বলে যে, দুনিয়াটা স্বার্থের জন্য আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। মামলাটির রায় দেওয়ার জন্য দিন ধার্য্য হয়ে পিটিশনারের আইনজীবীর আবেদনের কারণে বেশ কয়েকবার পিছিয়ে দিতে হয়েছে। কারণ তিনি একেক দিন একেক ধরণের এবং নতুন নতুন বিষয়ে সাবমিশন রাখেন। সর্বশেষ স্যার কোর্টকে বললেন, মাইলর্ডস আগামী তারিখে আপনি কাউকেই শুনবেন না, আমাকেও না, আপনি রায় দিয়ে দিবেন। কিন্তু ঐদিন পিটিশনারের আইনজীবী আরেকজন সিনিয়র নিয়ে এসে শুনানী করতে লাগলেন, স্যার ছিলেন তখন এপিলেট ডিভিশনে। স্যার এসে দেখে শুনানী চলছে। স্যার এসে তার সিটে বসলেন আর আস্তে আস্তে বললেন- সেকি, আজকেতো রায় হবে, কোন শুনানী হওয়ারতো কথা ছিল না। এরপর ঐ পক্ষের শুনানী শেষে, কোর্ট জানতে চাইলেন- মিঃ এ জে মোহাম্মদ আলী আপনি কিছু বলবেন। স্যার দাড়িয়ে বললেন, মাইলর্ডস গত তারিখেই আমি বলেছি- আজকে শুধু রায় দিবেন, কাউকেই শুনবেন না। আমি আমার কথাতে থাকতে চাই। আমার কিছুই বলার নাই। আপনি যদি মনে করেন এখন রায় দিবেন, তাহলে রায় দিয়ে দেন। সাথে সাথে জজ সাহেব বললেন- রুল ডিসচার্জড এবং স্যার মামলায় জিতে গেলেন।
স্যারের জানাজার দিন বর্তমান মাননীয় প্রধান বিচারপতি বললেন- তিনি আইনজীবী থাকতে বিভিন্ন মামলায় এ জে মোহাম্মদ আল এবং প্রায়াত এটর্নী জেনারেল জনাব মাহবুবে আলম এ দু’জনকে সিনিয়র নিতেন। স্যার ছিলেন আইনজীবীদের আইনজীবী। কোর্টে আসলে স্যারের সাথে দেখা হতো, কথা হতো, এখনও আমরা কোর্টে যাব কিন্তু এ জে মোহাম্মদ আলীকে আর কখনই দেখতে পাবো না।
মানুষ মরনশীল। আমাদেরকেও একদিন দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। স্যার বিগত ২ মে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আল্লাহ যেন স্যারের সকল ভুল ত্রæটি ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতে উঁচু মাকাম দান করেন। আমিন। আমরাও যেন স্যারের রেখে যাওয়া পথে সঠিক ভাবে হাটতে পারি।
মোঃ শামীম হোসেন
এডভোকেট
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।
বাংলাদেশ সময়: ১৮:২৫:৩১ ২৬৩ বার পঠিত