স্কুলশিক্ষক থেকে এমপি হওয়া সেই হেনরীর ৪৯ ব্যাংক হিসাবে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার লেনদেন * সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর ও তার স্ত্রী-কন্যার বিরুদ্ধেও দুদকের মামলা
দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিব্বুর রহমান ও সাবেক সংসদ-সদস্য জান্নাত আরা হেনরীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মহিব্বুরের স্ত্রী ও হেনরীর স্বামীর নামেও পৃথক মামলা করা হয়েছে। আর কামরুলের স্ত্রী-সন্তানের বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছে সম্পদ বিবরণী নোটিশ। স্কুলশিক্ষক থেকে এমপি হওয়া সেই হেনরীর ৪৯ ব্যাংক হিসাবে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পেয়েছে দুদক।
এছাড়া নির্ধারিত সময়ে সম্পদ বিবরণী দাখিল না করায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর (এসকে সুর), তার স্ত্রী সুপর্ণা সুর চৌধুরী ও মেয়ে নন্দিতা সুর চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। সোমবার মামলাগুলো দায়ের করা হয়। সংস্থার উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। জানা গেছে, প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ঢাকা-২ আসনের সাবেক এমপি ও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। সোমবার দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলাটি দায়ের করা হয়। এছাড়া কামরুল ইসলামের স্ত্রী বেগম তায়েবা ইসলাম, ছেলে ডা. তানজীর ইসলাম ও মেয়ে সেগুপ্তা ইসলামের সন্দেহজনক সম্পদের তথ্য পাওয়ায় তাদের সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে বলা হয়েছে।
এজাহারে বলা হয়েছে, কামরুল ইসলামের স্ত্রী তায়েবা ইসলামের সন্দেহজনক সম্পদ থাকতে পারে। ছেলে ডা. তানজীর ইসলামের এক কোটি ৪৬ লাখ ১৫ হাজার ৭৯৫ টাকা এবং মেয়ে সেগুপ্তা ইসলামের এক কোটি ১০ লাখ ৪৮ হাজার ৯২৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ পাওয়া গেছে। এছাড়া তাদের নামে ও বেনামে আরও সম্পদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
আর আসামি কামরুলের নামে ছয় কোটি ২৯ লাখ ১৯ হাজার ১৯৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ পাওয়া যায়, যা দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি পাবলিক সার্ভেন্ট ছিলেন এবং তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পদ অর্জন করেছেন, যার গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
এছাড়া তিনি নিজ এবং তার প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে পরিচালিত ১৫টি হিসাবে মোট ২১ কোটি ১৮ লাখ ১৫ হাজার ৪৬৫ টাকা লেনদেন করেন। তিনি এই টাকা সন্দেহজনকভাবে হস্তান্তর, রূপান্তর, স্থানান্তর করেছেন। যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২, এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
প্রসঙ্গত, গত ১৮ নভেম্বর রাজধানীর উত্তরা-১২ নম্বর সেক্টর থেকে কামরুল ইসলামকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গত ১৪ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুদক। ২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে সব জাতীয় নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন এই আওয়ামী লীগ নেতা। আইন প্রতিমন্ত্রী ও খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়ের পর খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে নিয়োগ, বদলি ও খাদ্য আমদানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ ওঠে।
মহিব্বুরের অবৈধ সম্পদ : ১১ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ ও ৩৯ কোটি টাকার সন্দেহভাজন লেনদেনের অভিযোগে পটুয়াখালী-৪ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য ও সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিব্বুর রহমান এবং তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সোমবার দুদকের সহকারী পরিচালক মিনহাজ বিন ইসলাম বাদী হয়ে মামলা দুটি দায়ের করেন। মহিব্বুর রহমানের বিরুদ্ধে ২০০০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব আমলে নেওয়া হয়েছে। যেখানে সাত কোটি ৬৪ লাখ ৩১ হাজার ৪৭৯ টাকার সম্পদের জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ অর্জন ও ২৩ ব্যাংক হিসাবে ২৩ কোটি ৭২ লাখ ৩৭ হাজার ৫৭৬ টাকা সন্দেহজনক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অপর মামলার আসামি তার স্ত্রী ফাতেমা আক্তার। তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ তিন কোটি ৯২ লাখ ১৯ হাজার ৭৫২ টাকার সম্পদের মালিকানা অর্জন ও তা দখলে রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে। যার স্বপক্ষে বৈধ মালিকানা পাওয়া যায়নি দুদক। এ ছাড়া তার নামে থাকা ১১টি ব্যাংক হিসাবে ১৫ কোটি ৫১ লাখ ৮৪ হাজার ৩৯৮ টাকা সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। যার মাধ্যমে মানি লন্ডারিং সম্পৃক্ত অপরাধ দুর্নীতি ও ঘুস সংঘটনের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ বা সম্পত্তির অবৈধ উৎস গোপন বা আড়াল করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সম্পদ অর্জনে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করায় এই মামলায় স্বামী মো. মহিব্বুর রহমানকে সহযোগী আসামি করা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর ২৭(১) ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারা এবং দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
হেনরীর দুই মামলা : জানা গেছে, হেনরী ও তার স্বামীর ৪৯ ব্যাংক হিসাবে পৌনে চার হাজার কোটি টাকা লেনদেন ও বিপুল সম্পদের অভিযোগে হেনরী ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সোমবার দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আসিফ আল মাহমুদ বাদী হয়ে মামলা দুটি দায়ের করেন। এজাহারে বলা হয়েছে, সিরাজগঞ্জ-২ আসনের আলোচিত সাবেক সংসদ-সদস্য জান্নাত আরা হেনরী ও তার স্বামী শামীম তালুকদারের ৪৯ ব্যাংক হিসাবে প্রায় তিন হাজার ৮৯৩ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে প্রায় ৭৮ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনেরও প্রমাণ পেয়েছে দুদক। গত ২০ আগস্ট হেনরীর বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু হয়। গত ১ অক্টোবর মৌলভীবাজার থেকে স্বামীসহ গ্রেফতার হন হেনরী।
এজাহারে বলা হয়েছে, আসামি ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ৫৭ কোটি ১৩ লাখ সাত হাজার ২২৩ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। আর তার স্বামীর অবৈধ সম্পদের পরিমাণ ২০ কোটি ৪৭ লাখ ৩৩ হাজার ২১৫ টাকা। হেনরী অবৈধভাবে প্রাপ্ত অর্থ বা সম্পত্তির অবৈধ উৎস গোপন বা আড়াল করার উদ্দেশ্যে ৩৫টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে দুই হাজার দুই কোটি ৬৬ লাখ ৫৭৭ টাকা ও ১৩ কোটি ৭৮ লাখ ৪৬ মার্কিন ডলারের (১১৫ টাকা হিসাবে প্রায় ১৫৮৫ কোটি টাকা) সন্দেহজনক লেনদেন করেছেন।
সোনালী ব্যাংকের পরিচালক থাকার সময়ে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ার সুবাদে অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন বলেও দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
আরেক মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আসামি মো. শামীম তালুকদার (লাবু) তার স্ত্রী জান্নাত আরা হেনরীর অপরাধলব্ধ অর্থ দ্বারা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের মালিক হয়েছেন। তিনি তার ১৪টি ব্যাংক হিসাবে ৩০৬ কোটি ৬৭ লাখ ৬৯ হাজার ৮৬০ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন করেছেন। যা মানি ল্ডারিং আইনে অপরাধ।
এসকে সুর ও স্ত্রী-কন্যার বিরুদ্ধে মামলা : জানা গেছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পদ বিবরণী দাখিল না করায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার (এসকে) সুর, তার স্ত্রী সুপর্ণা সুর চৌধুরী ও কন্যা নন্দিতা সুর চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। সোমবার মামলাটি দায়ের করা হয়।
এর আগে গত বছরের আগস্টে এই পরিবারের সব ধরনের লেনদেনের তথ্য চেয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেয় দুদক। আলোচিত পিকে হালদারের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে নাম আসায় ২০২২ সালে এসকে সুরসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। ওই বছরের ২৯ মার্চে এসকে সুরকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (আইএলএফএসএল) থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ লুটপাটের ঘটনায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়ছিল বলে জানা গেছে। এসকে সুর চৌধুরী ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ডেপুটি গভর্নরের পদ থেকে অবসরে যান।
অভিযোগ আছে এসকে সুর ডেপুটি গভর্নর থাকাকালে আলোচিত এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারের (পিকে হালদার) ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় সহযোগিতা করেছেন ও সুবিধা নিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ৭:২০:১৮ ১০ বার পঠিত