মহান বিজয় দিবস আজ। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি শাসন-শোষণ থেকে পুরো মুক্ত হয়েছিল জাতি। এবার ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে হাজির হয়েছে এই বিজয় দিবস। নতুন পরিবেশে উদ্যাপন হবে বিজয়ের এই বার্ষিকী। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের পর এই প্রথম উদ্যাপন হতে যাচ্ছে বিজয় দিবস। জুলাই আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে প্রায় দেড় হাজার মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছেন। আহত ও পঙ্গুত্ববরণ করেছেন কয়েক হাজার মানুষ। তাদের এই ত্যাগের বিনিময়ে স্বৈরাচারী শাসকের পতনকে অনেকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে আখ্যা দিয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে সূচনা হওয়া আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত করতে এতে যুক্ত হয়েছিলেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। সবার সম্মিলিত ত্যাগ আর আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রের সংস্কার ও একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে কাজ করছে। ৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের পর এবার ভিন্ন এক পরিবেশ দেশে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রায় সবাই আত্মগোপনে। অনেকে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে। দলটির কর্মীরাও আর দৃশ্যপটে নেই। বিএনপি, জামায়াতসহ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত রাজনৈতিক দলগুলো এবং তাদের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা এবার স্বাধীনভাবে বিজয় দিবস উদ্যাপনের সুযোগ পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসন আমলে নানা বিধি-নিষেধের মধ্যে বিজয় দিবস উদ্যাপন করতে হয়েছে তৎকালীন বিরোধী দলগুলোকে। গ্রেপ্তার-নির্যাতন ও হয়রানির ভয়ে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানেও অংশ নিতে পারেননি অনেকে।
তাই এবার নতুন প্রেক্ষাপটে নতুন উদ্দীপনায় উদ্যাপন হতে যাচ্ছে বিজয় দিবস। এবারের এই দিবসে মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হবে। পাশাপাশি ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে জীবন দেয়া শহীদদেরও স্মরণ করবে পুরো দেশ। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলি, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হামলায় আহত অনেকে এখনো হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। কেউ হাত হারিয়েছেন, কেউ পা। কারও চোখের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে স্বৈরাচারের বুলেট। আহত এই মানুষদের রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি। যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তারা সরকার পতনের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তা পূরণে এবারের বিজয় দিবসে আবারো শপথ নেবে সর্বস্তরের মানুষ। বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ে ছাত্র-জনতা আবারো মুষ্টিবদ্ধ শপথ নেবে বিজয় দিবসে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনায় গড়ে তোলার যে স্বপ্ন ছিল বিগত সময়ে নানা কারণে তা পুরো অর্জিত হয়নি। রাজনৈতিক হানাহানি, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের কারণে মলিন হয়ে পড়েছিল বিজয়ের ক্যানভাস। ৫ই আগস্টের পর বৈষম্যমুক্ত নতুন এক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়েছে ছাত্র-জনতার তরফে। নতুন বাংলাদেশ গড়তে একগুচ্ছ সংস্কার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। গঠন করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্কার কমিশন। সংস্কারে সায় দিয়েছে প্রায় সব রাজনৈতিক দল। তাই অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে নতুন করে দেশ গড়ার।
জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা না হলেও আগামী বছরই একটি নির্বাচন আয়োজনের চাপ আছে সব পক্ষ থেকে। গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার শেষে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সেই সরকার ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূরণে আত্মনিয়োগ করবে এমন প্রত্যাশা সামনে রেখেই এবার উদ্যাপন হচ্ছে বিজয় দিবস। দেশে আর যাতে কোনো শাসক স্বৈরাচারী হতে না পারে। লুটপাট করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিদেশে পাচার করতে না পারে। নাগরিক হিসেবে সবাই সমান অধিকার ভোগ করতে পারে- এমনটিই হবে এবারের বিজয় দিবসের অঙ্গীকার।
দিবসটি উপলক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সশস্ত্র বাহিনী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিস্তারিত কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ভোরে তোপধ্বনি ও জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে শুরু হবে দিবসের কর্মসূচি। প্রত্যুষে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এরপর যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, প্রধান বিচারপতি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা নিবেদনের পর জাতীয় স্মৃতিসৌধের ফটক খুলে দেয়া হবে সর্বসাধারণের জন্য।
দিবসটি উপলক্ষে সারা দেশে সরকারি, আধা-সরকারি ও বেসরকারি অফিস ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। রাতে গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় আলোকসজ্জা করা হবে। আজ সরকারি ছুটির দিন।
দিবসটি উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান উপদেষ্টা পৃথক বাণীতে দেশবাসীকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। বিজয় দিবসে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন বাণীতে দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত দেশ গড়ার পাশাপাশি ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনা ও মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আরও অবদান রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। এ বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণ যে বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল, তা শিগগিরই বাস্তবায়িত হবে, এমন আশাও প্রকাশ করেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাণীতে ছাত্র, শ্রমিক ও জনগণের গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ায় একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও সুশাসিত বাংলাদেশ গড়তে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর শহীদদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিজয় দিবস শুধু আমাদের গর্বের উৎস নয়, আমাদের শপথ দিবসও। তিনি আরও বলেন, শপথ হলো ঐক্যবদ্ধ থাকা, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার। বিজয় দিবসকে বাংলাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গৌরবময় ও স্মরণীয় দিন হিসেবে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের মধ্যদিয়ে জাতি হিসেবে স্বাধীনতা ও আত্মপরিচয়ের স্বাদ পেয়েছি।
বাংলাদেশ সময়: ২০:১০:৪৩ ২১ বার পঠিত