রাজধানীর বারিধারা ডিওএইচএস এলাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এলএস ক্যাবল অ্যান্ড সিস্টেম। এই প্রতিষ্ঠানের সাব ঠিকাদার বিএনএফ ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড। বছর তিনেক আগে কাজ না করে দিয়েই বিএনএফ ইঞ্জিনিয়ার্স এল এস ক্যাবলের কাছে ৫৩ কোটি টাকা দাবি করে। পরে পাওনা টাকার অভিযোগ এনে বিএনএফ ইঞ্জিনিয়ার্সের এমডি মোস্তফা কামাল বাদী হয়ে আদালতে মামলা দায়ের করেন। প্রতিষ্ঠান প্রধান ছাড়াও এ মামলায় অন্য আসামিরা হলেন ঐ প্রতিষ্ঠানের কোরিয়ান ইঞ্জিনিয়ার স্যাম স্যাং হোয়াইও, ইঞ্জিনিয়ার হং উ লি, ইঞ্জিনিয়ার সুদীপ চক্রবর্তী, হিসাব শাখার ব্যবস্থাপক ইমাম হোসেন ও ইঞ্জিনিয়ার নাফিস মোহাইমিন। পরে এই মামলায় প্রত্যেকে জামিন পান। পরবর্তী সময়ে গত ১০ ডিসেম্বর এই মামলায় আসামিদের আদালতে হাজিরার তারিখ ছিল। এর আগেই ৪ ডিসেম্বর ইমাম হোসেন ও নাফিজ মোহাইমিনের কাছে কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠানো একটি চিঠি আসে। চিঠি খুলে তারা দেখতে পান যে গত ১৯ নভেম্বর আদালতে জনৈক অনিক কুমার দাস তাদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগটি মামলা হিসাবে গ্রহণ করে আদালত সেটি তদন্ত করার জন্য কোতোয়ালি থানা পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে।
মামলায় অনিক কুমার দাস অভিযোগ করেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তার শরীরে চারটি বুলেট বিদ্ধ হয়। আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৫৪ জনকে। আসামি তালিকার ২১৫ নম্বরে ইমাম হোসেন এবং ২১৬ নম্বরে নাফিজ মোহাইমিনের নাম রয়েছে। আসামির তালিকায় এই দুই জনের নাম দেখে এলএস ক্যাবল অ্যান্ড সিস্টেমের কর্মকর্তারা হতবাক হয়ে যান। তাদের অভিযোগ, আসামির তালিকায় থাকা ঐ দুই জন কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী নয়। এমনকি কোনো রাজনীতির সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা নেই।
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর রাজধানীর বিভিন্ন থানা এলাকায় তাণ্ডবের ঘটনায় দায়ের করা প্রায় সব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আসামি করার পাশাপাশি ব্যক্তি আক্রোশ কিংবা পূর্বশত্রুতার জেরেও অনেককে আসামি করার অভিযোগ রয়েছে। একই ব্যক্তির নাম পাঁচ-ছয়টি মামলার এজাহারে যেমন আছে, ঘটনার দিন এলাকায় ছিলেন না, এমন ব্যক্তির নামও আছে। এছাড়া অজ্ঞাত আসামি করে অনেক ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তার কাছ থেকে এখনো মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হচ্ছে। মামলার বাদীর সঙ্গে আঁতাঁত করে তৃতীয় একটি পক্ষ কতিপয় পুলিশের যোগসাজশে আসামির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
রফিকুল ইসলাম সরকার। স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। তাকে উত্তরায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত ট্রাক হেলপার হত্যা মামলার আসামি করা হয়। তিনি মামলার ৪৩ নম্বর আসামি। আদালতে দায়ের করা এ মামলার বাদী রকিবুলকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এজাহারে তার মোবাইল নম্বর দেওয়া হলেও তা বন্ধ। কিন্তু তৃতীয় একটি পক্ষ রফিকুলের কাছ থেকে আসামির তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করছে। মান-সন্মানের ভয়ে কারো সঙ্গে আলোচনাও করতে পারছেন না তিনি। বর্তমানে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সহকারী অথরাইজড অফিসার আওরঙ্গজেব সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ধানমন্ডিতে কলেজ শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ সিদ্দিক হত্যা মামলার আসামি করা হয়। এরপর তার নাম আসামির তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করেছে একটি চক্র। বর্তমানে তার কাছ থেকে আরো টাকা আদায়ের চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে। এছাড়া সরকারি আরো বেশ কজন কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীর কাছ থেকে একইভাবে টাকা আদায়ের চেষ্টা চলছে।
অন্যদিকে রেহানা আক্তার নামের মিরপুর এলাকার একজন নারী উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময় কতিপয় আওয়ামী লীগের নেতা ও স্থানীয় সন্ত্রাসীরা তার ব্যবসা ছিনিয়ে নেয়। বর্তমানে বিচারের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘোরা এই নারীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে ঐ চক্র। বলা হচ্ছে তিনি আওয়ামী লীগের দোসর। আর তার ছেলে জুলাই আগস্টের ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় থাকলেও তাকে বানানোর চেষ্টা চলছে ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে। এ মামলার বাদী জেসমনি নামের এক নারী। তিনি জানান, আসামি কে তা তিনি জানেন না। কেন মামলার বাদী হলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এলাকার নেতারা বলেছে তাই। তারা কিছু টাকাও দিয়েছে বলে জানান তিনি।
আসামির তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার কথা বলে ২ লাখ টাকা চাঁদা নেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য সিরাজুল ইসলাম আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। গত মঙ্গলবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে তিনি এ জবানবন্দি দেন। পুলিশ বলছে, জবানবন্দিতে সিরাজুল ইসলাম চাঁদা নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। চাঁদা নেওয়ার সময় উপস্থিত থাকা এক র্যাব সদস্যর নামও তিনি জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন।
গত ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সংঘর্ষের ঘটনায় রবিউল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থী নিহত হয়। এ ঘটনায় পৃথকভাবে পাঁচটি মামলা হয়। এর মধ্যে একটি মামলায় বাদী রবিউলের ভাই। বাকি মামলাগুলোর বাদীর সঙ্গে নিহত রবিউলের কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। এই বাদীদেরই কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে এজাহার থেকে আসামির নাম বাদ দেওয়ার বাণিজ্য শুরু করেছেন। আর এই কাজ করা হচ্ছে হলফনামার (অ্যাফিডেভিট) মাধ্যমে। এর সঙ্গে যোগসাজশ আছে রাজনীতিকদেরও। রবিউল হত্যার ঘটনায় হওয়া একটি মামলার বাদী রিয়াদ হোসেন নামের এক যুবক। আন্দোলনে তিনিও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তিনি ১০৫ জনের নাম উল্লেখ করে ও ৬০০ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। এই মামলায় আসামি মজিবর রহমান (৫৬) নামের এক ব্যক্তি। গত ২৯ আগস্ট মামলার বাদী রিয়াদ তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে এজাহার থেকে নাম বাদ দেওয়ার হলফনামা করেন। মামলার এজাহার থেকে যেন নিজের নাম বাদ দেওয়া হয়, সে জন্য হলফনামার একটি কপি মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জমা দেন মজিবর।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার হিড়িক পড়েছে। গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা করা হচ্ছে। শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানাতেই প্রায় এক ডজন হত্যা, বিস্ফোরক ও নাশকতার মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রায় প্রতিটি মামলাতে গড়ে দুই শতাধিক মানুষকে আসামি করা হয়েছে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ মামলা আতঙ্কে ভুগছেন। কখন কার বিরুদ্ধে মামলা হয় এই আতঙ্কে তটস্থ সাধারণ মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একটি প্রতারক চক্র মামলা হওয়ার আগেই শহরের বিভিন্ন কম্পিউটারের দোকান থেকে মামলার কপি বানিয়ে এসব ভুয়া মামলার কপি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। যাদেরকে এসব ভুয়া মামলায় আসামি করা হয়, তাদেরকে মামলার কপি দেওয়া হচ্ছে মেসেঞ্জার বা হোয়াটস অ্যাপে। পরে তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিব্রত অবস্থায় পড়েছে পুলিশ প্রশাসন। গত ২৯ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার পুলিশের পক্ষ থেকে ভুয়া প্রতারকদের কাছ থেকে জনগণকে সাবধান থাকার জন্য সতর্ক করা হয়েছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব হলফনামা খুব বেশি জোরালো ভূমিকা রাখে না। অনেকেই মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করে অ্যাফিডেভিট করছেন। এতে খুব একটা লাভ হবে না। কারণ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি ঘটনার সঙ্গে ঐ ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা পান, সে ক্ষেত্রে তিনি তো তাকে অব্যাহতি দেবেন না। আইন অনুযায়ী বাদী আদালতে উপস্থিত হয়ে জবানবন্দি দিলে আদালত পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। প্রকৃতপক্ষে মানুষের মধ্যে একধরনের ভীতি কাজ করছে, আর এ সুযোগটাই হয়তো কেউ কাজে লাগাচ্ছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, ৫ আগস্টের পর ঢাকার বিভিন্ন থানায় অনেক মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় বাদী ইচ্ছে করে অনেক আসামি করেছেন। এসব গণ-মামলা গণ-আসামি থাকবে না। তদন্ত শেষে নির্দিষ্ট ঘটনায় যেসব আসামির নাম আসবে ঠিক তাদের নাম মামলায় থাকবে। যেসব বাদী মামলা বাণিজ্য করছেন তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা হবে। মামলা অপকর্মে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯:০৫:৪৯ ১৩ বার পঠিত