থানা ও ফাঁড়ি থেকে লুণ্ঠিত ১ হাজার ৪১৯ আগ্নেয়াস্ত্র আর ২ লাখ ৬৩ হাজার ১৫৩ রাউন্ড গুলির নেই খোঁজ। জেল পালানো দাগি অন্তত ৭০০ আসামি এখনও ‘নিখোঁজ’। এত সংখ্যক অস্ত্র-গুলির হদিস না পাওয়া আর আসামি ধরতে না পারায় জনমনে তৈরি হয়েছে নিরাপত্তা শঙ্কা। এর মধ্যেই চিহ্নিত অপরাধীরা লুট করা অস্ত্র ব্যবহার করে একের পর এক অপকর্ম করেই যাচ্ছে।
সর্বশেষ মুন্সীগঞ্জের শ্রীপুরে এক্সপ্রেসওয়েতে সাহিদা ইসলাম নামে এক তরুণীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় প্রেমিক তৌহিদ শেখ তন্ময়কে গ্রেপ্তার করা হয়। এর পর বেরিয়ে আসে, ৫ আগস্ট রাজধানীর ওয়ারী থানা থেকে লুট করা অস্ত্রে গুলি চালিয়ে সাহিদাকে হত্যা করেন তৌহিদ। এর আগে মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্পেও একাধিকবার আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে মহড়া দেয় মাদক কারবারিরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র বলছে, কাঠামো দেখে বোঝা যায়, বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র ছিল লুণ্ঠিত।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘিরে দেশের বিভিন্ন থানা-ফাঁড়িতে হামলা ও লুট হয়। পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য বলছে, সব মিলিয়ে লুট করা হয় ৫ হাজার ৭৫০ অস্ত্র । গোলাবারুদ লুট হয়েছে ৬ লাখ ৫১ হাজার ৬০৯ রাউন্ড। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত যৌথ অভিযানে ৪ হাজার ৩৩১টি অস্ত্র জব্দ করা হয়েছে। তবে এখনও বেহাত ৭.৬২ বোরের ১২৯টি রাইফেল, ৩০টি এসএমজি, চারটি এলএমজিসহ বিভিন্ন ধরনের ১ হাজার ৪১৯ আগ্নেয়াস্ত্র। এ ছাড়া ৫ আগস্ট গণভবন থেকে নিরাপত্তা সংস্থা এসএসএফের বেশ কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র খোয়া যায়।
এদিকে অস্ত্র উদ্ধারে ৪ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় যৌথ অভিযান। ওই অভিযান এখনও চলছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বেহাত অস্ত্র দ্রুত জব্দ করাই অভিযানের মূল লক্ষ্য।
তবে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেহাত অস্ত্র নানা রাজনৈতিক সংঘাত, সহিংসতা ও অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। কোনো কোনো অপরাধীর হাতে এসব অস্ত্র থাকার তথ্য মিলছে। আর লুণ্ঠিত অস্ত্রের পাশাপাশি জেল পলাতক আসামিরাও নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারেন।
জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের সময় দেশের কারাগার থেকে পালিয়েছেন ২ হাজার ২০০ আসামি। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৫০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এখনও অধরা ৭০০ আসামি। এর মধ্যে জঙ্গি, ফাঁসির দণ্ড পাওয়া, শীর্ষ সন্ত্রাসীর মতো অতিঝুঁকিপূর্ণ ৭০ আসামি রয়েছেন। এ ছাড়া কারাগার থেকে এখন পর্যন্ত জঙ্গি মামলায় ১৭৪ আসামি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। এ ছাড়া ১১ শীর্ষ সন্ত্রাসীও মুক্তি পান।
পুলিশ সদরদপ্তরের মুখপাত্র এআইজি ইনামুল হক সাগর বলেন, বেহাত অস্ত্র যাতে চিহ্নিত অপরাধীসহ অন্য কেউ ব্যবহার করতে না পারে, সেদিকে বিশেষ নজর রাখা হয়েছে। কারও কাছে অস্ত্র রয়েছে– এমন সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলে জনগণ যাতে পুলিশকে জানায়।
অপরাধ ও সমাজ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, পুলিশের অস্ত্র ও গুলি বেহাত থাকা নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা অবৈধ অস্ত্রের নানামাত্রিক ব্যবহার দেখছি। যদি দ্রুত লুণ্ঠিত অস্ত্র ব্যবহার না হয়, তাহলে অপরাধীরা তা সাধারণ মানুষের বিপক্ষে ব্যবহার করবে– এমন শঙ্কা তৈরি হবে। অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক সাজা নিশ্চিত না করলে অস্ত্র লুটের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। আর জেল পলাতক আসামির একটি অংশ ফের অপরাধে জড়াতে পারে। যাদের বড় সাজা হয়েছে বা সাজার মুখোমুখি হতে পারেন, তাদের কেউ দেশ থেকে পালিয়েও যেতে পারেন।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার মুখপাত্র লে. কর্নেল মুনিম গণমাধ্যমকে বলেন, লুট করা অস্ত্র উদ্ধার ও জেল পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ দিকনির্দেশনা রয়েছে। সরকারি স্থাপনার বাইরেও যাদের ব্যক্তিগত অস্ত্র জমা হয়নি, তা জব্দ করতে অভিযান চালাচ্ছি। যৌথ বাহিনীর পাশাপাশি র্যাব নিজেরাও এই আভিযানিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
অপরাধ প্রবণতার গতিবিধির ওপর নজর রাখেন– আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পদস্থ এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, লুট করা অস্ত্র এক পক্ষ আরেক পক্ষের কাছে বিক্রি করছে কিনা, সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে। সম্প্রতি লুট করা অস্ত্র বিক্রি করার ছক কষছিল– একজন দুর্বৃত্তের তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে এসেছে।
মুন্সীগঞ্জে তরুণী সাহিদা বেগমকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় তৌহিদ নামে যে যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এরই মধ্যে ৫ আগস্ট ওয়ারী থানা থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশের লুট করা অস্ত্র তৌহিদের মতো অপরাধে যুক্ত আরও অনেকের হাতে চলে যেতে পারে। এমনকি সংঘবদ্ধ ডাকাত, সন্ত্রাসী, কিশোর গ্যাং, জলদস্যু ও বনদস্যুর কাছে গেছে বলে কারও কারও শঙ্কা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, যৌথ অভিযানের পাশাপাশি পুলিশ বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমেও অস্ত্র লুটের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে। থানায় যারা হামলা করেছে, তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অপরাধী, দুর্বৃত্তসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ যুক্ত ছিল। লুট হওয়া অস্ত্রগুলো দাগি অপরাধীদের কাছে থাকতে পারে।
মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শামসুল আলম সরকার বলেন, ৫ আগস্ট ওয়ারী থানা থেকে লুট করার পর পুলিশের পিস্তলটি বাসায় লুকিয়ে রাখেন বলে স্বীকার করেন তৌহিদ। ওই অস্ত্র দিয়ে তরুণীকে হত্যার আগে অন্য কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ডে এটি ব্যবহার হয়েছে কিনা, তদন্ত চলছে।
মুক্তি পেয়েছে ১১ শীর্ষ সন্ত্রাসী
বর্তমানে সব কারাগার মিলিয়ে প্রায় ৪২ হাজার বন্দি ধারণক্ষমতার তথ্য তুলে ধরে কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন বলেন, ৫ আগস্টের আগে বন্দির সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০ হাজার। সরকার পরিবর্তনের পর জামিন হওয়ায় বন্দির সংখ্যা কমে প্রায় ৫৫ হাজারে আসে। এখন এ সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৬৫ হাজারে ঠেকেছে। সরকার পতনের পর জামিনে মুক্ত হওয়া আসামির মধ্যে ১৭৪ জঙ্গি ও ১১ শীর্ষ সন্ত্রাসী রয়েছে। গতকাল বুধবার রাজধানীর কারা সদরদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
কারা মহাপরিদর্শক বলেন, ১৯ জুলাই নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা চালিয়ে অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটে। এ সময় কারাগারে থাকা ৮২৬ বন্দি পালিয়ে যান। ওই ঘটনায় কারাগারে নিয়োজিত বিভিন্ন পর্যায়ের ২০১ কর্মকর্তা-কর্মচারী আহত হয়েছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ৭:৫৮:৪২ ৫৪ বার পঠিত