টালমাটাল দক্ষিণ কোরিয়া। মুহূর্তে মুহূর্তে নতুন নতুন নাটকীয়তা। বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। মঙ্গলবার বেশ রাতে দেশে সামরিক আইন জারি করে বেকায়দায় প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইয়োল। তার এ নির্দেশের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে পুরো দেশ। পার্লামেন্টের ভিতর আটকে পড়া এমপিরা সামরিক শাসনকে প্রত্যাখ্যান করে প্রস্তাব পাস করেন। দেশজুড়ে চলতে থাকে প্রেসিডেন্ট ইউন-বিরোধী বিক্ষোভ। পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে তিনি সামরিক শাসন তুলে নেন। ঘটনা সেখানে থেমে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু না। তা যেন তুষের আগুনের মতো ভিতর থেকে জ্বলে উঠেছে। উল্টো এবার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইয়োলের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু করেছেন এমপিরা। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো সহ আন্তর্জাতিক দুনিয়া কড়া দৃষ্টি রেখেছে দেশটির ওপর। মঙ্গলবার রাতে টেলিভিশন ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইউন জানান, উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট শক্তির কবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে এবং দেশের ভিতর থেকে রাষ্ট্রবিরোধীদের উৎখাতের জন্য প্রয়োজন সামরিক আইন। তিনি এক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার কাঁধে কাঁঠাল ভেঙে খেতে চাইলেও পরে জানা যায়, দেশের ভিতরেই তীব্র চাপে আছেন তিনি। ধারাবাহিক বেশ কিছু স্ক্যান্ডাল ঘিরে ধরেছে তাকে। এছাড়া পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, নিজস্ব রাজনৈতিক সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট। তার মধ্যে তিনি ক্ষমতাকে ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে তিনি সামরিক আইন ঘোষণা দেয়ার দুই ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে এমপিরা জোর করে পার্লামেন্ট ভবনের ভিতরে প্রবেশ করেন এবং প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তকে আটকে দিতে ভোট করেন। কোনো কোনো এমপি ব্যারিকেড ভেঙে পার্লামেন্টের ভিতরে প্রবেশ করেন। একজন এমপি বলেছেন, তিনি দেয়াল টপকে প্রবেশ করেছেন। পার্লামেন্টে তাদের ভোটের পর প্রেসিডেন্ট ইউন ইউটার্ন নেন। সামরিক আইন জারি সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসেন। এখন তার বিরুদ্ধে কয়েক দিনের মধ্যে অভিশংসন প্রস্তাবের ওপর ভোট করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এমপিরা। যদি তাদের ভোটে প্রেসিডেন্ট অভিশংসিত হন তাহলে সাংবিধানিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে প্রেসিডেন্ট ইউনকে। এমন পরিস্থিতিতে তালগোল পাকিয়ে গেছে দেশটির রাজনীতিতে।
প্রেসিডেন্ট ইউনের সামরিক আইন জারির পরিকল্পনার সমর্থক ছিলেন তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী কিম ইয়োং-হিউন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বুধবার তিনি পদত্যাগ করেছেন। পরিস্থিতির জন্য তিনি প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন জাতির কাছে। বলেন, সামরিক আইন জারি করার পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব তিনি নেবেন। বার্তা সংস্থা ইয়োনহাপের মতে, প্রেসিডেন্ট ইউনের পাশাপাশি প্রতিরক্ষামন্ত্রী কিম ইয়ং-হিউনের বিরুদ্ধেও অভিশংসন প্রস্তাব আনার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এমপিরা। কেন দেশটিতে এমন পরিস্থিতি হলো তার অনুসন্ধান করেছে বিবিসি। এতে বলা হয়, বেশ কিছু বিতর্কের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইয়োলের স্ত্রী। অভিযোগ আছে তিনি বিলাসবহুল ডিয়র মডেলের একটি ব্যাগ গ্রহণ করেছেন। গত বছর কোরিয়ান বংশোদ্ভূত মার্কিন একজন পাস্তুরের কাছ থেকে এই ব্যাগটি গ্রহণ করেন তার স্ত্রী। এমন ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এর মধ্য দিয়ে উপহার নেয়া বিষয়ক আইন ভঙ্গ করেছেন। কিন্তু এর জবাবে প্রেসিডেন্ট ইউনের গৃহীত পদক্ষেপ তাকে আরো গরম পানিতে ফেলে। গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা ওই ভিডিও নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইউন বলেন, দেশটির পার্লামেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে তার দলের ক্ষতি করার জন্য এই ভিডিও বানানো হয়েছে। তিনি আরও দাবি করেন ডিয়র মডেলের ২২০০ ডলারের ওই ব্যাগটি আন্তরিকভাবে নিতে অস্বীকার করেছিলেন ফার্স্টলেডি। কিন্তু এপ্রিলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তার দল মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে। বাড়তে থাকে অসন্তোষ। অবশেষে এই স্ক্যান্ডাল ছড়িয়ে পড়ার পুরো এক বছর পরে গত মাসে স্ত্রীর পক্ষ হয়ে ক্ষমা চান প্রেসিডেন্ট ইউন। এ ঘটনায় কোনো রকম তদন্তের অনুমতি দেননি তিনি। এর পর থেকে জনক্ষোভ তীব্র থেকে তীব্র হতে থাকে। জনমত বলছে, শুধু এই একটি বিষয় নয়। আরও অনেক কারণে প্রেসিডেন্টের রেটিং কমে গেছে। প্রেসিডেন্ট মঙ্গলবার সামরিক আইন জারি করার পর উত্তাল হয়ে ওঠে দেশটির রাজনীতি। রাতের তাপমাত্রা নেমে যায় প্রায় শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসে। সেই হিম ঠান্ডা উপেক্ষা করে শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েন। তারা সমবেত হন গাংহামুন স্কয়ারে। সেখান থেকে প্রেসিডেন্ট ইউনের বিরুদ্ধে অভিশংসনের দাবি তোলা হয়। মঞ্চে উঠে জনতা গান গাইতে থাকে। উল্লাস করতে থাকে। তাদের হাতে ছিল প্রজ্বলিত মোমবাতি এবং ইউনিয়ন ফ্লাগ। অনেকে হাতে দেখা যায় ‘বিদ্রোহের অভিযোগ ইউন সুক ইয়োলকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে’ লেখা পতাকা। সেখানে উৎসবের এক আবহ ছড়িয়ে পড়ে।
ওদিকে কিছু রাজনীতিক প্রেসিডেন্ট ইউনের পক্ষ নিয়েছেন। তার মধ্যে আছেন দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হোয়াং কিও-আহন। তিনি বলেছেন, প্রেসিডেন্টকে অভিশংসিত করা উচিত হবে না। প্রেসিডেন্ট ইউনের সামরিক আইন জারির যৌক্তিকতাকে সমর্থন করেছেন। বলেছেন, প্রেসিডেন্টের সামরিক আইন জারির সিদ্ধান্তের পর এমপিদেরকে সমবেত করতে এবং প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তকে আটকে দেয়ার আহ্বান জানান জাতীয় পরিষদের স্পিকার। এ জন্য তাকে গ্রেপ্তার করা উচিত বলে তিনি দাবি করেন। বুসান সিটির কাউন্সিলম্যান পার্ক জং-চিওল বলেন, সামরিক আইন জারির ঘোষণাকে তিনি সক্রিয়ভাবে এবং সহানুভূতির সঙ্গে সমর্থন করেন। ডায়েগু শহরের মেয়র হং জুন-পিও তার ফেসবুকের পেস্টে অভিশংসনের পক্ষে অমত জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ০:০৩:২৪ ৫২ বার পঠিত