সৈয়দ মো: রেজাউজ জামান হীরা
সন্ধ্যায় ধৈই ধৈই করে বৃষ্টির তেজ বাড়ছে। সাথে খিটখিটে আসন্ন শীতের ঝাপটানি। ঋুুতুর এই উল্টাপাল্টা বাড়াবাড়ি সহ্য হয়না মনসুর আলীর। তাছাড়া তার বয়সীরা শস্য শ্যামলা স্ত্রী নিয়ে যখন আমোদ আহলাদে মাতোয়ারা,তখন তারা দুইজন পাশাপাশি বসে নিস্তেজ,নিরব, যেন এখানে কোন উত্তাপ নেই,এখানের ভালবাসায় আগুনের ফুলকি জ্বলেনা।
‘‘তোমাকে আমি কিছু বলতে চাই” সুলতা বলল।
‘‘আরো কিছুটা সময় যাক না এমনি ভাবে”
মনসুর আলীর এ কথায় কিঞ্চিৎ অসহিষ্ণু সুলতা।
মাঝখানে টেবিল। এপাশে সুলতা ওপাশে মনসুর আলী। টেবিলের মাঝখানে প্রদীপ। নীচে আঁধার। মাঝে শব্দহীনতা।
”বিদুৎ যে কখন আসবে শার্টটা ইস্তি করা দরকার।”—আপনমনে বলে উঠে মনসুর আলী। তারপর আবার নীরবতা।
আচমকা প্রশ্ন করে মনসুরআলী—“সূর্য় না কর্ণ কে তোমার কাছে বেশী প্রিয়?”
প্রশ্ন শুনে কিছুটা অবাক হয় সুলতা।
সুলতা বাংলার ছাএী। বাংলা সাহিত্যে এম.এ করেছে। গনিতের শিক্ষক ডঃ মনসুরআলী ওর কাছেই শুনেছিল কর্ণের জন্ম কাহিনী।
কৌতূহল বশতঃ কুন্তী সূর্যকে আহবান করল। সেই আহবানে সাড়া দিয়ে সূর্য বলল “তোমার আহবান বৃথা যাবেনা, আমার সাথে মিলনের ফলে তোমার পুত্র লাভ হবে এবং তুমি কুমারীই থাকবে।” সেই কুন্তী আর সূর্যের মিলনের ফসল কর্ণ। কর্ণকে কুন্তী অবৈধ বিবেচনা করে তার জন্ম পরিচয় লুকিয়ে পৃথিবীর সামনে দাঁড় করাল পাঁচ পান্ডবকে। যারা কুন্তীর স্বীকৃত সন্তান। আর কর্ণ বড় হলো শক্রু দূর্যোধনের আশ্রয়ে। চারদিকে যখন হিংস্রার আগুন জ্বলছে,তখন কুন্তী কর্ণের আসল পরিচয় প্রকাশ করল এবং যুধিষ্ঠির বড় ভাই হিসাবে রাজ্যের ভার গ্রহন করতে বলল। কিন্তু কর্ণ রাজ্য চাইল না। কেননা, তাহলে তার চিরশক্রু যুধিষ্ঠির রাজ্য লাভ হবেনা। আর যদি রাজ্য গ্রহন করে তাহলে সে পান্ডবদের চিরশক্রু দূর্যোধনকেই দান করবে,কারণ সে তার সাহায্যেই বড় হয়েছে। কর্ণ এভাবেই দূর্যোধনের মতো একজন ঘৃনিত মানুষের ঋনে আবদ্ধ হয়ে মহত্তে¡ আটকা পড়েছেন।
“কিন্তু আমি কর্ণের মতো মহৎ নই সুলতান” কথাটি বলে মনসুর আলী তার মোটা কালো ফ্রেমের চশমাটা নাকের ডগা থেকে উপরের দিকে ঠেলে দিলেন, এটা তার পুরনো অভ্যাস।
ডঃ মনসুর আলী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বয়স ৪৫,মাথা ভর্তি কাঁচা পাকা চুল,এই চুলে চিরুনীর ছোঁয়া খুব কমই পায়, চুলগুলোও এলোমেলো থাকতেই যেন বেশী পছন্দ করে । সবসময় চোখে কালো ফ্রেমের চশমা থাকে। উচ্চতা ৫ফুট ৭ইঞ্চি, চওড়া গড়ন। গায়ের রং শ্যামলা। ভরাট কন্ঠ। জীবনান্দের “বনলতা সেন” ওর কন্ঠে বেশ শোনায়। সুলতার সাথে তার বয়সের ব্যবধান প্রায় পনের বছর। পারিবারিক ভাবেই ওদের বিয়ে হয়েছে। ওদের বিয়ের পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হলো। ওরা নিঃসন্তান।
জায়েদ আহমেদ,শিল্পপতি। মনসুর আলীর কলেজ জীবনের বন্ধু। মনসুরের বাড়ীতে তার অবাধ যাতায়াত। ইদানিং জায়েদের সাথে মনসুরের চেয়ে সুলতার হৃদ্যতাই বেশী চোখে পড়ে। মনসুরআলী যখন বিশ্ববিদ্যালয় থাকে, সেই সময় আসে জায়েদ। প্রথম প্রথম কিছুই বুঝতে পারেনাই মনসুরআলী। সে ভেবেছে সুলতা সারাদিন একা একা থাকে জায়েদ তাকে সময় দিচ্ছে মন্দ কি। কিন্তু একদিন ———
শ্রাবনের দুপুর। আকাশের বুক চিরে অঝরে ঝরছে বৃষ্টি। ক্লাস শেষে টিচার্স রূমে ফিরে বৃষ্টি দেখতে লাগল। হঠাৎ সুলতার কথা মনে পড়ল। ওর সাথে ইদানিং খুব একটা কথা হয়না,অথচ একটা সময় ছিল ওকে ছাড়া একদন্ড চলত না মনসুরআলীর। ভাবল সবকিছু কি আগের মতো হয়না। সাথে সাথে রিক্্রা নিয়ে বাড়ীর পথে রওয়ানা হলো সে। ফুলের দোকান থেকে রজণীগন্ধার স্টিক কিনল। রজণৗগন্ধা সুলতার খুব প্রিয়। বিয়ের পর প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে ফুল কিনে তবে বাড়ী ফিরত। যদিওবা কখনও ফুল নিতে ভূল হতো তাহলে সুলতা অভিমানে গাল ফুলাত। সুলতা যখন রাগত তখন ওর ফর্সা গাল লাল হয়ে যেত,আর ওর বাঁশীর মতো নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমত। মনসুর আলীর খুব ভাল লাগত। তখন সে সুলতাকে জড়িয়ে ধরে আদর করত, সুলতা বলত “ছোঁবেনা কিন্তু” তবে মনসুরের বুক থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতনা। একথা মনে হতেই মনসুর আলী শব্দ করে হাসল। মনসুরের হাসি শুনে রিক্্রাওয়ালা ঘাড় ফিরে তাকাল এবং দাঁত কেলিয়ে নিজেও হাসল।সে রিক্্রাওয়ালাকে বলল“ হুডটা ছেড়ে দাও ভাই, একটু বৃষ্টিতে ভিজব।” রিক্্রাওয়ালা হুডটা ছেড়ে দিল বিনা বাক্যে। সে জানে শিক্ষিত লোকেরা একটু পাগলা কিছিমের হয়। মনসুরআলীর সাথে সেও বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে জোরে প্যাডল চাপতে লাগল।
মনসুর ওর বাড়ীর সামনে জায়েদের সাদা রংয়ের গাড়ীটা দেখে চমকে উঠল। পরে খুশী হলো অনেকদিন বাদে জমিয়ে আড্ডার কথা ভেবে। বাসার দরজা খোলাই ছিল। আবার চমকে উঠল সে কারন এই ভূল সুলতার হওয়ার কথা না। সন্দেহ হলো তার। ড্রয়িংরুমে কেউ নেই। বেডরুম থেকে আশা ভোসলের‘‘ছোট্ট একটা ভালবাসা চায়গো সবাই” গানটা ভেসে আসছে। এগিয়ে গেল সে বেডরুমের দিকে। ওর অতিপরিচিত বিছানায় তখন আদিম খেলায় ব্যস্ত ওরা দুইজন। এই দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়ে গেল সে। ড্রয়িংরুমে ফিরে ভিজা কাপড়ে সোফায় বসল। বাইরে বৃষ্টির সাথে জোরে বাতাস বইছে। ড্রয়িংরুমের জানালাগুলো সজোড়ে আঘাত করতে লাগল, খেয়াল নেই তার, কেননা নিজের ভেতরের আঘাতে সে ক্ষতবিক্ষত।
বেডরুম থেকে বের হয়ে সুলতা আর জায়েদ ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠল মনসুরকে দেখে। জায়েদের দিকে তাকিয়ে অতি ঠান্ডায় গলায় বলল ‘‘ভালো আছ”। সুলতা আমতা আমতা করতে বলল ‘‘এসেছো কখন?” সুলতার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শুধু একটু হাসল। তারপর অবশ শরীরটা টেনে নিয়ে চলল বাথরুমে। অনেক সময় নিয়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে গোসল করল, গোসল শেষে দেখল সুলতা নেই, টেবিলে চাপা দেয়া একটা চিরকুট।
রামকিংকরের মূতির্,
জায়েদের সঙ্গে বের হলাম।আমার খোজঁ না করলে খূশী হবো। ভাল থেকো।
চিরকুটটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ভালই হলো সুলতার মুখোমুখি হতে হলোনা। সুলতা খুবই বুদ্ধিমতি মেয়ে। এবার সে সন্তানের জনক বেছে নিয়েছে, আর একটা মূর্তি যেন তার ভাগ্যে না জোটে।
দিন যায়। রাত যায়। মাস যায়। নেই। সুলতা কোথাও নেই। সেও সুলতাকে খুজেঁ নাই। তার সময়ও কাটতে লাগল নিজস্ব নিয়মে। হঠাৎ আজ বিকালে সুলতা এসে উপস্থিত।
“বসন্ত শেষ”-শব্দ দুইটি বলে ব্যাগটা রেখে চেনা মানুষের মতো বাথরুমে চলে গেল গোসল করতে।
সুলতাকে দেখে মনসুর কিছুটা আর্শ্চয হয়েছে। তবুও সে কোন কথা বলল না, খাটে হেলান দিয়ে বই পড়তে লাগল। প্রায় অর্ধোউদোম হয়ে গোসল সেরে বের হলো সুলতা।
- ওর উদোম পিঠে আঘাতের চিহ্ন। তবে কি জায়েদ সুলতার গায়ে হাত তুলত? মনসুর ভাবতে লাগল।
“ফ্রিজে কি আছে?” সুলতা প্রশ্ন করে। প্রশ্ন শুনে মনসুর বলে“ সর্ষে ইলিশ করা আছে”। সুলতা নীল রঙয়ের শাড়ী পড়েছে। কপালে ছোট একটা টিপ। ভেজা চুল পিঠের উপর ছড়ানো। মনসুর সুলতার চোখের দিকে তাকাল। চকিতে সুলতা চোখ নামিয়ে নিল। সে মনসুরের চোখে চোখ রাখতে পারছিলনা।
সুলতা টেবিলের ওপাশ থেকে উঠে এসে নিজের ওষ্ঠ দিয়ে মনসুরআলীর ঠোঁট ভিজিয়ে বলল –‘‘একে শুধুমাত্র যৌবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করনা লক্ষীসোনা। আামার কথা শোন। আমি আমার তলপেট খুলে দিলাম হাত রাখ এখানে।” চমকে উঠে মনসুরআলী, সুলতার তলপেট যথেষ্ঠ স্ফীত। ওর চমকে উঠা এড়ায়না সুলতার চোখে। তাই সে বলে -“মা হতে চলেছি।” সুলতার মুখে তৃপ্তির হাসি। এই হাসি মনসুরআলীর শরীরে যেন আগুন ধরিয়ে দিল। হঠাৎ তার ইচ্ছে করছে ওর মুখের হাসি চিরতরে নিভিয়ে দিতে। কিন্তু পরক্ষনে সেই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল। কারন মায়ের পর মনসুর ওকেই ভালবেসেছে।
মনসুর জিজ্ঞেস করল -“তাকে ছাড়লে কেন?”
“তোমার জন্য”-
“আমি তো রামকিংকরের মূর্তি। তাছাড়া তুমিতো ভালবেসে জায়েদের হাত ধরে ঘর ছেড়েছো।”
সুলতা মনসুরকে জড়িয়ে ধরে কান্নাভেজা কন্ঠে বলল “বিশ্বাস কর আমি ভূল করেছি। জায়েদ একটা অমানুষ, দেখ দেখ আমাকে মেরে কি করেছে।”সুলতা শাড়ীর আঁচল ফেলে বøাউজ খুলে বুকের আর পিটের আঘাতের চিহ্ন দেখালো। ওর পিটে আঘাতের চিহ্ন দেখল মনসুর, কিন্তু কোন কথা বললনা। শুধু আঁচলটা তুলে দিল।
তারপর বলল –“সুলতা তোমার মনে আছে- যেদিন ডাক্তার বলল আমি কোনদিন বাবা হতে পারবনা। সেদিনই আমি তোমাকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলাম। তখন তুমি বলেছিলে সন্তান ছাড়াও তোমার চলবে কিন্তু আমাকে ছাড়া তোমার চলবেনা। এতবড় মিথ্যা কথা তখন কেন বললে।” কথাগুলো বলে মাথা নিচু করে বসে পড়ল মনসুর।
ধীর পায়ে এগিয়ে এসে সুলতা মনসুরের মাথা তার বুকে চেপে ধরে বলল –“ক্ষমা কর।আমি তোমাকে ভালবাসি। তোমাকে ছাড়া আমার চলবেনা।আমাকে ক্ষমা করো প্রিয়তম।”
বিদ্যুৎ চলে এসেছে। চারদিক আলোয় ভরে উঠেছে। মনসুর নিজেকে সুলতার আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে শার্ট ইস্তি করার জন্য অন্যরূমে চলে গেল। শার্ট ইস্তি করছে ঠিকই , তবে তার মাথার ভেতরে হাজার মাইল বেগে চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কি করবে এখন সে। সে ভাবছে ডির্ভোসের কথা। কারন সুলতা নষ্ঠ হয়ে গেছে, প্রতারনা করেছে তার সাথে।এবার মনসুরের বিবেক তার সামনে এসে দাঁড়ল—‘মনসুর তুমি কেন তাকে ডির্ভোস দিতে চাও? মা হতে চাওয়া নিশ্চয়ই দোষের নয়। তুমি তো অক্ষম,কোনদিন বাবা হতে পারবেনা। তাই তোমার উচিত তোমার ভালবাসার মানুষের গর্ভের সšতানকে কোলে তুলে নিয়ে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করা।সুলতা তোমাকে সত্যিই ভালবাসে মনসুর।তাইতো ফিরে এসেছে। আমার কথা শোন তুমি সূর্যের পুত্র কর্ণের মতো মহত্তে¡র নজীর স্থাপন কর।”
সে আর ভাবতে পারেনা, মাথা ঝিম হয়ে আসে,সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা। সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও ডঃ মনসুর আলীর অক্ষমতা প্রকাশ পাচ্ছে। সে রাগে হিট দেয়া আয়রনটা শার্টের উপর চেপে ধরল। শার্ট পুড়ে যাচ্ছে। তার মাথার উপর ফুলস্পিডে ফ্যান ঘূরছে। তবুও সে দরদর করে ঘামছে।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশে সুপ্রীম কোর্ট
বাংলাদেশ সময়: ১৫:১৮:০২ ১৭৬ বার পঠিত