‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে এই জনতা, এই জনতা।’ কবি সলিল চৌধুরীর দেশাত্মবোধক গানের এই কলিটি এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল। আপিল বিভাগের বহু বিতর্কিত অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক দেশ ছেড়ে পালাতে গিয়ে সীমান্তে বিজিবির হাতে গ্রেফতার হন। এরপরই ভাইরাল হয় গানের কলিটি।
বিচারপতি মানিক বেশ কিছু বিতর্কিত মামলা ও মিডিয়ায় নানা বিষয়ে মন্তব্য করে আলোচনায় আসেন। সবশেষ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় একটি টিভি চ্যানেলের টক শোতে নারী উপস্থাপিকার সঙ্গে বাজে আচরণ করেন তিনি। ওই অনুষ্ঠানে নারী উপস্থাপিকাকে রাজাকারের বাচ্চা বলে সম্বোধন করেন। আবার যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল বা সংস্কার চায় সেসব শিক্ষার্থীকেও রাজাকারের বাচ্চা বলে মন্তব্য করেন এই সাবেক বিচারপতি।
বিচারপতি মানিক দীর্ঘ প্রায় দুই দশক ধরে নানা কাজে বিতর্ক তৈরি করেছেন। আর এসব বিতর্কের কারণেই তিনি এত পরিচিত। দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে বিচারপতি মানিক এক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত করেছেন বলে আদালতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
প্রসঙ্গত, শুক্রবার রাতে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ভারতে যাওয়ার প্রাক্কালে সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত থেকে আটক করে বিজিবি। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি অবসরে যান। এরপর বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও টেলিভিশন টক শোতে কথা বলতেন তিনি। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে হত্যার ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি মামলা হয়। এর পর থেকে তিনি পলাতক ছিলেন।
বিচারপতি মানিকের আসল নাম আবুল হোসেন মোহাম্মদ শামসুদ্দিন চৌধুরী। তিনি ১৯৭৮ সালে হাইকোর্টের আইনজীবী হিসাবে তার কর্মজীবন জীবন শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি বাংলাদেশের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হন। ২০০১ সালের ৩ জুলাই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তাকে অতিরিক্ত বিচারক হিসাবে হাইকোর্ট বিভাগে নিয়োগ দেয়। একই বছর বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সে নিয়োগ স্থায়ী করা হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিচারপতি হিসাবে পুনর্বহাল হন।
বিচারপতি থাকা অবস্থায় শামসুদ্দিন মানিককে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। যে রায়টি কেন্দ্র করে সমালোচনার কেন্দ্রে আসেন সেটি হচ্ছে, কর্নেল তাহের হত্যা মামলার রায়। সে রায়ে বিচারপতি মানিক কর্নেল তাহেরের বিচারকে ‘ঠান্ডা মাথার খুন’ হিসাবে বর্ণনা করেন। তিনি জিয়াউর রহমানকে ‘ঠান্ডা মাথার খুনি’ হিসাবে বর্ণনা করেন। ২০১৫ সালে আপিল বিভাগের বিচারপতি থাকা অবস্থায় শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সঙ্গে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন।
তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে একটি বেঞ্চ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার অভিশংসন চেয়ে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠিও দিয়েছিলেন। অবসরে যাওয়ার কয়েকদিন আগে তিনি এ কাজ করেছিলেন।
২০১২ সালের শেষের দিকে বিমানের বিজনেস ক্লাসে সিট না পাওয়া নিয়ে বিচারপতি মানিক লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়েছিলেন। সেই ঘটনার জেরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার নোটিশ জারি করেছিলেন শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। পরে বিমানের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ চারজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হাইকোর্টে বিচারপতি মানিকের বেঞ্চে গিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমতা চেয়ে নিষ্কৃতি পান।
জানা যায়, ২০১২ সালে বিচারপতি থাকা অবস্থায় লন্ডনে তিনি হামলার শিকার হয়েছিলেন তিনি। এছাড়া ২০১৫ সালে অবসর গ্রহণের পর আবারও তিনি লন্ডনে হামলার শিকার হন। শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে। তিনি বাংলাদেশের পাশাপাশি ব্রিটেনেরও নাগরিক।
২০১২ সালের জুন মাসে তৎকালীন জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সংসদ সদস্য বিচারপতি মানিকের সমালোচনা করেছিলেন। আদালতে বসে বিচারপতি মানিক তৎকালীন সংসদের স্পিকার আব্দুল হামিদের (পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি) নজিরবিহীন সমালোচনা করেছিলেন। তিনি স্পিকারকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘স্পিকার সুপ্রিমকোর্ট ও সংবিধান সম্পর্কে তার অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। স্পিকার তার সংসদীয় অধিকারের অপব্যবহার করেছেন।’ এরপর বিচারপতি মানিকের সমালোচনার ঝড় ওঠে সংসদে।
শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে অপসারণের লক্ষ্যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করার জন্য তারা প্রধান বিচারপতি এবং রাষ্ট্রপতিকে তিন দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন। শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে ‘স্যাডিস্ট’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন তৎকালীন সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ। তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, তিনি (বিচারপতি মানিক) মানুষকে অপমান করতে পছন্দ করেন। যারা স্যাডিস্ট, অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়, আমরা তাদের ঘৃণা করি।
তৎকালীন সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংসদে বলেছিলেন, ‘শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক তার পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন।’ তোফায়েল আহমেদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছাড়াও শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও রাশেদ খান মেনন শামসুদ্দিন চৌধুরীর মানিকের সমালোচনা করেছিলেন। সংসদে এই সমালোচনার পরও শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের কোনো সমস্যা হয়নি। সংসদের সমালোচনার ছয় মাস পরই তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসাবে ২০১৩ সালে পদোন্নতি পান।
তার চেয়ে সিনিয়র ২১ জন বিচারককে অতিক্রম করে এ পদোন্নতি পান। ওই সময় দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বিচারপতি মানিকের অপসারণের দাবি জানান। মাহমুদুর রহমান তার (বিচারপতি মানিক) বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ এনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে শাস্তি চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি কোনো ব্যবস্থা নেননি।
অভিযোগ আছে, বিচারপতি থাকাকালে ট্র্যাফিক পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তার গাড়ি দেখেও স্যালুট না করায় আদালত অবমাননার অভিযোগ করেছিলেন তিনি। পুলিশের মহাপরিদর্শক শহিদুল হক বলেছিলেন ট্র্যাফিক পুলিশ কাউকে অভিবাদন জানাতে বাধ্য নয়। পরে হাইকোর্ট শহীদুল হকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেন। যা তাকে (শহীদুল হক) আইন অনুসারে মহাপরিদর্শকের পদ থেকে সরিয়ে দেয়। পরে শহিদুল হক রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমা লাভ করেন এবং চাকরি ফিরে পান।
বিচারপতি মানিক ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে অবসর নেওয়ার পর ৬৫টি আদেশ ও রায় জমা দিয়েছিলেন। তার দাবি ছিল-তখন ২০টি রায় এবং আদেশ বাকি ছিল। আপিল বিভাগের বিচারপতি ইমান আলীকে রায়গুলো পরীক্ষা করার আদেশ দেওয়া হয় এবং বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞাকে এগুলো পর্যালোচনা করার আদেশ দেওয়া হয়।
সুপ্রিমকোর্টের নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে একটি সংবাদ সম্মেলন করার জন্যও বিচারপতি মানিক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন। যেখানে তিনি অবসর গ্রহণের পর তার কাছ থেকে পুরোনো রায় গ্রহণ করার জন্য প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ করেছিলেন। প্রধান বিচারপতি তাকে সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের অফিসে সব রায় এবং নথি পাঠাতে ও সংবাদ সম্মেলন না করার নির্দেশ দেন।
গণমাধ্যমে বিচারপতি সিনহার সমালোচনা করার ফলে ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ তার বিরুদ্ধে একটি মানহানির মামলা হয়েছিল। মামলাটি আদালত ২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর তা খারিজ করেন। ২০২১ সালের অক্টোবরে ই-কমার্স ইভ্যালি পরিচালনার জন্য বিচারপতি মানিকের নেতৃত্বে একটি চার সদস্যের কমিটি করা হয়। কিন্তু তার নেতৃত্বাধীন কমিটি কার্যকর সুপারিশ দিতে ব্যর্থ হয়।
সবশেষ সরকারি বাড়ি ভাড়া পরিশোধ না করার অভিযোগে বিচারপতি মানিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান করতে দুদককে নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের এক আইনজীবী। একটি গণমাধ্যমের সংবাদকে উদ্ধৃত করে নোটিশে উল্লেখ করা হয়, অবসরে যাওয়ার পর এক বছরের বেশি সময় রাজধানীর গুলশানে একটি সরকারি বাড়ি দখলে রেখেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।
জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন শনিবার বলেন, এ পর্যন্ত যত বিচারপতি এসেছেন, তার মধ্যে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিচার বিভাগ ধ্বংসের জন্য যা কিছু করা দরকার সবই করেছেন। তিনি শপথ করেছিলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি বৈষম্য করবেন না, সংবিধান সংরক্ষণ করবেন। সবগুলোই তিনি ভঙ্গ করেছেন। তিনি বিচার বিভাগকে কলঙ্কিত করেছেন। বিচার বিভাগকে অকার্যকর করার জন্য যেসব কর্মকাণ্ড করা দরকার, সবগুলোই তিনি করেছেন। দেশ এবং বিচার বিভাগের স্বার্থে তার (বিচারপতি মানিক) দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।
সুপ্রিমকোর্টের আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ শনিবার বলেন, শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক কখনোই বিচারকসুলভ আচরণ করেননি। তিনি যা ইচ্ছে তাই করতেন। ভয় দেখিয়ে রায় ও আদেশ দিতেন। আইনের মাধ্যমে তার শাস্তি হওয়া উচিত।
বাংলাদেশ সময়: ০:৫৫:৩৪ ৭৭ বার পঠিত