কোটা আন্দোলন ঘিরে গ্রেফতার-রিমান্ড উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও আইন উপেক্ষিত

প্রথম পাতা » জাতীয় » কোটা আন্দোলন ঘিরে গ্রেফতার-রিমান্ড উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও আইন উপেক্ষিত
সোমবার, ৫ আগস্ট ২০২৪



কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার পর থেকেই ব্যাপক ধরপাকড়ের অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে।

সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন: আটকের পর ২৪ ঘণ্টায় আদালতে তোলার আইন মানা হচ্ছে না। রিমান্ডের নামে অধিকাংশই অমানবিক নির্যাতনের শিকার-অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার পর থেকেই ব্যাপক ধরপাকড়ের অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে। আন্দোলনে অংশ নেননি-এমন ব্যক্তিদের যেমন ধরা হচ্ছে, তেমনি স্কুল-কলেজ পড়ুয়া সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিশুদেরও ধরা হচ্ছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন শিশুকে নিম্ন আদালত রিমান্ডে পাঠালে সমালোচনা তৈরি হলে রিমান্ড বাতিল করা হয়।

এমন পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগীদের স্বজন ও আইনজীবীরা শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছেন-গ্রেফতার ও রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানছেন না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গ্রেফতারের পর আদালতে তোলার আগে এবং রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে অমানবিক নির্যাতন করা হচ্ছে। বিষয়টিকে মানবাধিকার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন দাবি করে নিম্ন আদালতের নজরে আনলে কোনো প্রতিকার মিলছে না বলেও তাদের অভিযোগ। তবে পুলিশ ও সরকারি কৌঁসুলিরা বলছেন, আইন ও আদালতের নির্দেশনা মেনেই আটক ও রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

অভিযোগ রয়েছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে ২০ জুলাই মধ্যরাতে খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়ার এক বাসা থেকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। নাহিদ গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন, তাকে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। আঘাতের কারণে তার দুই কাঁধ ও পায়ে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। গণমাধ্যমে আঘাতের সেসব ছবি প্রকাশ পেয়েছে।

একই অভিযোগ করেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের স্ত্রী মারিয়া নুর। ডিআরইউতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ১৯ জুলাই রাত সাড়ে ৩টার দিকে ঘরের দরজা ভেঙে নুরকে তুলে নেওয়ার ৩৯ ঘণ্টা পর আদালতে তোলা হয়। নুর তাদের জানিয়েছেন, ডিবি তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর অকথ্য নির্যাতন করেছে। এমনকি দুদফা রিমান্ডে তাকে ইলেকট্রিক শক ও ইনজেকশন পুশ করেছে। নুরের আইনজীবীরাও নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন।

আদালতে হাজিরের সময় নুর হাঁটাচলা এমনকি ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছিলেন না, এমন ভিডিও গণমাধ্যমে প্রচার হয়। ভুক্তভোগীদের আইনজীবী ও স্বজনরা জানিয়েছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুলিশ এলোপাতাড়ি ধরপাকড় করছে। পরবর্তী সময়ে নাশকতা ও ভাঙচুরের বিভিন্ন মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে। অনেককে আটকের পর ২৪ ঘণ্টায় আদালতে তোলার আইন মানা হচ্ছে না। এছাড়া রিমান্ডের নামে বেশিরভাগকে অমানবিক নির্যাতন করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীব জেডআই খান পান্না শনিবার গণমাধ্যমকে বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে আটক বা গ্রেফতার করার কোনো নিয়ম নেই। এক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, যা অবশ্যই মানতে হবে। তিনি বলেন, কাউকে কোনো কারণে আটক করা হলে ৩ ঘণ্টার মধ্যে তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ, সেটি জানাতে হবে। একই সঙ্গে আটক ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন ও তার আইনজীবীকেও বিষয়টি জানাতে হবে। এছাড়া কাউকে সন্দেহভাজন হিসাবে কাউকে আটকের পর শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না, তেমনি রিমান্ডেও জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় করা যাবে না।

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন শনিবার গণমাধ্যমকে বলেন, গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেওয়ার বিষয়ে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও কোটা সংস্কার আন্দোলনসংশ্লিষ্টদের ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। যারা গ্রেফতার-রিমান্ডের নামে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিত বলে তিনি মনে করেন।

আইন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, রিমান্ডে নেওয়ার কারণ নিয়ে আইনে বলা হয়েছে, কোনো মামলায় প্রকৃত আসামির পরিচয় পাওয়া না গেলে জড়িত থাকতে পারে এমন সন্দেহভাজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে রিমান্ড আবেদন করা যায়। কোনো মামলায় একাধিক আসামি থাকলে, গ্রেফতার একজনের কাছ থেকে বাকি আসামিদের সম্পর্কে তথ্য জানতে রিমান্ডে নেওয়া যায়। ঘটনার ক্লু, ঘটনার বিবরণ বা অপরাধের উদ্দেশ জানতে রিমান্ডে নেওয়া যায়। অন্যদিকে, রিমান্ড নিয়ে সংবিধানে বলা আছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার ফৌজদারি কার্যবিধির অপপ্রয়োগই নয়, সংবিধানেরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

পুলিশ এই নির্দেশনা কতটা মানছে জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ শনিবার গণমাধ্যমকে বলেন, রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুলিশ উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানছে না। সংবিধানেও বলা আছে, কাউকে রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক অত্যাচার-নির্যাতন করা যাবে না। কিন্তু দিনের পর দিন আদালতের আদেশ মানা না হলেও কোনো প্রতিকার মিলছে না।

ফুঁসে উঠেছে ছাত্র-জনতা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল গণমাধ্যমকে বলেন, কাউকে আটক বা গ্রেফতারের ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩৩ ও ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেসব নিয়মের তোয়াক্কা করছে না। তবে আইন মেনে গ্রেফতার ও রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে-এমন দাবি করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ শনিবার গণমাধ্যমকে বলেন, গ্রেফতার ও রিমান্ডে নির্যাতনের অভিযোগ ঠিক না। আইন ও আদালতের নির্দেশনা মেনেই গ্রেফতার কিংবা রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া অহেতুক কাউকে গ্রেফতারও করা হচ্ছে না। যারা প্রকৃত অপরাধী তাদেরই গ্রেফতার করা হচ্ছে।

এদিকে, শিশুদের আটক বা রিমান্ডের ক্ষেত্রেও আইন মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ আইনজীবী ও স্বজনদের। আইনজীবী তাসমীর উদয় গণমাধ্যমকে বলেন, শিশু আইনের ৪৪(৩) ধারা অনুযায়ী, গ্রেফতার করার পর শিশুকে কোনো অবস্থাতেই হাতকড়া বা মাজায় দড়ি বা রশি পরাতে পারবে না পুলিশ। তবে তারা সেটি মানছেন না।

দেখা যায়, ৩১ জুলাই ১৬ বছর ১০ মাস বয়সি এক কলেজ শিক্ষার্থীকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে ও দড়ি বেঁধে ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করা হয়। এর আগে ২৭ জুলাই আইনগতভাবে শিশু হিসাবে স্বীকৃত এক শিক্ষার্থীকে ৭ দিনের রিমান্ডে পাঠানোর আদেশ দিয়েছিলেন ঢাকার একটি আদালত। সেটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও নাগরিকদের মধ্যে তুমুল সমালোচনা তৈরি হলে এক দিন পর তার রিমান্ড বাতিল করেন আদালত। পাশাপাশি তাকে টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।

আইনজীবী তাসমীর উদয় আরও বলেন, সুনির্দিষ্ট নয়, অজ্ঞাতনামা আসামি হিসাবে বেশ কয়েকজন শিশুকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের জন্মসনদ ও একাডেমিক সার্টিফিকেট আদালতে উপস্থাপন করার পরও রিমান্ড মঞ্জুর করায় স্পষ্ট যে, সেখানে আইন মানা হয়নি। সামগ্রিক বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি মো. আব্দুল্লাহ আবু শনিবার গণমাধ্যমকে বলেন, গ্রেফতার নিয়ম লঙ্ঘন ও রিমান্ডে নির্যাতনের অভিযোগ সত্য নয়। আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনেই রিমান্ডে পাঠানো হচ্ছে। তবে কেউ রিমান্ডে নির্যাতনের শিকার হলে আদালতের নজরে আনতে পারেন। তখন আদালত ব্যবস্থা নেবেন।

বাংলাদেশ সময়: ১০:৩৭:২০   ৮৭ বার পঠিত  




জাতীয়’র আরও খবর


শেখ হাসিনা-জয়ের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু
বেশ কয়েকজন বিচারপতির অনিয়মের পূর্ণাঙ্গ তদন্তে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন
হাসিনার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির তথ্য দেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
হাসান আরিফ ছিলেন দেশের উজ্জ্বল নক্ষত্র: আইনজীবীরা
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা নতুন করে তদন্ত হওয়া উচিত: হাইকোর্ট
শেখ হাসিনার নির্দেশেই ইন্টারনেট বন্ধ হয়: পলক
গুমে জড়িত ২০ জনের পাসপোর্ট স্থগিত, দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় জামায়াতের প্রয়াত আমিরকে মৃত্যুদণ্ড ও অর্থদণ্ড থেকে খালাস
১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা খালাস পেলেও এখনই মুক্তি মিলছে না বাবরের
আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় লুৎফুজ্জামান বাবরের খালাস

Law News24.com News Archive

আর্কাইভ