সকাল সাড়ে ১১টা। ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের গারদখানার সামনে ভিড়, কান্নাকাটি। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার পর আটকদের রাখা হয়েছে এই গারদখানায়। রাজধানীর বিভিন্ন থানা থেকে প্রিজনভ্যানে করে তাদের এখানে আনা হয়। স্বজনরা এসেছেন তাদের একনজর দেখতে, কথা বলতে। গতকাল বৃহস্পতিবারের চিত্র এটি।
নবম শ্রেণির ছাত্র আমির হামজাকে বুধবার দুপুরে রাজধানীর শেখেরটেকের ১২ নম্বর রোড থেকে আটক করে পুলিশ। একই সঙ্গে আটক করা হয় দশম শ্রেণির ছাত্র নাইম ইসলামকে। তারা দু’জন একসঙ্গে মোবাইল ফোনে খেলছিল।
১৫ বছরের আমিরের মা রেহেনা বেগম চাকরি করেন সাইনেস্ট অ্যাপারেলসে। গতকাল সিএমএম আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে ছেলের জন্য কাঁদছিলেন রেহেনা। তিনি বলেন, ‘শখ করে ছেলেকে মোবাইল কিনে দিলাম, সেটাই কাল হলো।’ পুলিশ তাঁকে জানিয়েছে, আমির হামজার মোবাইল ফোনে অপরাধমূলক মেসেজ পাওয়া গেছে। আমিরের বাবা ভোলার লালমোহনের বাসিন্দা মো. কাওসার জানান, তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে আদাবর থানায় নাশকতার মামলা দিয়েছে পুলিশ।
রাজধানীর আগারগাঁও বিএনপি বাজারে মো. খোকন (৪০) কাঁচামরিচ, লেবু ও ধনেপাতা বিক্রি করেন। সোমবার দুপুরে বাজার থেকে তাঁকে আটক করে পুলিশ। আগারগাঁও থানায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বাজারের আরেক দোকানদার মো. কবির গতকাল সিএমএম আদালতে আসেন খোকনের খোঁজ নিতে। তিনি বলেন, ‘খোকনকে আদালতে তোলার কথা রয়েছে।’
রিমান্ডে ২৩ ও কারাগারে ২৭৫ জন
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা ও নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার ২৭৫ জনকে গতকাল কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। তাদের মধ্যে আমির হামজা ও নাইম ইসলামও রয়েছেন। ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত তাদের কারাগারে পাঠান। এদিন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থসহ ২৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
এদিন যাত্রাবাড়ী থানার চার মামলায় ২০ জন, পল্টন থানার দুই মামলায় ১৩ জন, মতিঝিলের দুই মামলায় ৪, মিরপুরের দুই মামলায় ১৫, উত্তরা পশ্চিম থানার দুই মামলায় ৬, উত্তরা পূর্ব থানার ৬ মামলায় ২৫, কদমতলী থানার ৬, তুরাগের ৭, মোহাম্মদপুরের দুই মামলায় ১০, ভাটারা থানার ২, বনানী থানার ৪, গুলশানের ২, ধানমন্ডির দুই মামলায় ৩, হাতিরঝিলের দুই মামলায় ৬, রমনার ১, সবুজবাগের ৩, নিউমার্কেট থানার ৪, কোতোয়ালির ৫, পল্লবীর ৪, কাফরুলের ৩, সূত্রাপুরের ৫, ডেমরার ৬, মুগদার ৩, রূপনগর থানার ২, বাড্ডার দুই মামলার ২০, বংশালের ৫, রামপুরার ১৫, কলাবাগানের দুই, শেরেবাংলার ১, ওয়ারীর ১০ এবং ক্যান্টনমেন্ট থানার ১০ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
ছেলের জন্য কাঁদছেন রুমা বেগম
২২ বছর বয়সী মিজানকে বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টর থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। খবর পেয়ে তাঁর বাবা মকবুল হোসেন ও মা রুমা বেগম গতকাল সকালে লৌহজং থেকে ঢাকায় আসেন। আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে ছেলের জন্য অঝোরে কাঁদছিলেন রুমা বেগম। তিনি জানান, ৭ হাজার টাকা বেতনে মোহাম্মদপুরের একটি সাইনবোর্ড তৈরির কারখানায় কাজ করে মিজান। পুলিশ আটকের পর উত্তরা পশ্চিম থানায় তার বিরুদ্ধে ভাঙচুরের মামলা দিয়েছে। রুমা বেগম বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, কাম করে খাই। রাজনীতি বুঝি না। বাবারা আমার ছেলেটাকে এনে দেও।’ মিজানের বাবা মকবুল লৌহজং বাজারে ভ্যানে ফল বিক্রি করেন। চোখের পানি মুছতে মুছতে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে এমন কী অপরাধ করল যে, জেলে থাকতে হবে। এখন কী হবে, কবে ছাড়া পাবে?’ বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে ভালোবাসেন বলে জানান মকবুল। মিজান নিরাপরাধ বলেও দাবি করেন।
প্রিজনভ্যান দেখলেই এগিয়ে যান রোজা
হৃদয় খানকে বুধবার রাজধানীর মাতুয়াইলের ডগাই থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বছরখানেক আগে ভালোবেসে রোজা ইসলামকে বিয়ে করেন ২৪ বছরের হৃদয়। স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে গতকাল সকাল থেকে সিএমএম আদালতের সামনে মা রত্না বেগমকে নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন রোজা। প্রিজনভ্যান দেখলেই এগিয়ে যান। কিন্তু বেলা ৩টা পর্যন্ত হৃদয়ের দেখা পাননি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে রোজা বলেন, ‘আমার স্বামীর কোনো দোষ নেই। সে অপরাধী নয়। রাজনীতিও করে না। স্টেডিয়ামের হাইফাই ট্রেডার্সে চাকরি করে।’ রোজার বাবা বিদেশে থাকেন। রত্না বেগম বলেন, ‘আমার একটা মেয়ের কপাল পুড়ল।’
বাংলাদেশ সময়: ১০:৪১:০০ ৭৫ বার পঠিত