মার্চ মাস। গণমাধ্যমে খবরে সয়লাব বেনজীর আহমেদের সম্পদের তথ্যে। একের পর এক বেরিয়ে আসে তার হাজার কোটি টাকার সম্পদের খবর। এ নিয়ে তুমুল আলোচনা। মাসখানেকের মধ্যেই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বেনজীরের সম্পদের খোঁজে নামে। এতে আরও চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। মাঠে ঘাটে পথে প্রান্তরে বেনজীর আহমেদকে নিয়ে চলে নানা চর্চা। সংবাদ মাধ্যমেও এ চর্চা কম হয়নি। সে সঙ্গে একে একে দুদকের জালে ধরা পড়েন আরও পুলিশ সদস্যসহ কিছু প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা। এসব নিয়ে গত দু’মাসে সংবাদ মাধ্যমগুলো ব্যাপক ব্যস্ত।
হঠাৎ করে চলতি মাসেই শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন রূপ নেয় ভয়াবহ সহিংসতায়। খবরের পাতা থেকে আড়াল হয়ে গেল দুর্নীতির অভিযোগ থাকা বেনজীর-মতিউরসহ আলোচিতদের নাম। সহিংসতা দমনে চলমান কারফিউর খবর শোভা পাচ্ছে দুর্নীতি দমনের খবরের স্থানে।
এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধানে নামার একটি পরিকল্পনা ছিল শিগগিরই। সম্প্রতি চীন সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, তার এক পিয়নও ৪০০ কোটি টাকার মালিক। সেই উক্তির পর জাহাঙ্গীর আলমকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয় গণমাধ্যমে। শুধু তাই নয়, দুদকের অনুসন্ধানের খবরও জানা যায় সেদিন। দুদক জানায়, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে চাকরি হারানোর পরপর জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ জমা হয়। বেশ কিছুদিন যাচাই বাছাই শেষে অনুসন্ধানের বিষয়ে যাবার সুপারিশও দিয়েছিল কমিশনকে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর ৪০০ কোটির মালিক পিয়ন উক্তির পর জানা গেল অনুসন্ধানের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে দুদক। কিন্তু এর মধ্যেই সে আলোচনা ঢেকে গেল কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া সহিংসতা ও পরবর্তী সময়ে সরকার ঘোষিত কারফিউর কারণে।
দুদক সূত্র বলছে, বেনজীর আহমেদ ও রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে সম্পদের নোটিশ জারি করেছে দুদক। গতকাল সোমবার ছিল তাদের সম্পদ বিবরণী জমা দেয়ার শেষ দিন। কিন্তু হঠাৎ করে দেশব্যাপী কোটা নিয়ে আন্দোলনে তৈরি হওয়া নতুন সংকটের কারণে চলছে নির্বাহী আদেশে সাধারণ ছুটি। ফলে বেনজীর-মতিউরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ হচ্ছে না দুদকের।
সূত্র মতে, দুদক কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণী নোটিশ জারি করলে আইন অনুযায়ী তাকে ২১ দিনের মধ্যে তা জমা দিতে হয়। এর মধ্যে না দিলে অভিযুক্ত ব্যক্তি আবেদনের প্রেক্ষিতে আরও ১৫ দিন সময় পান। তবে প্রথম ২১ দিনের মধ্যে যদি সময় না চান সেক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে নন সাবমিশনে মামলা করতে পারবে দুদক।
কিন্তু বেনজীর আহমেদ ও মতিউর রহমানের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের বিবরণী জমা দেয়ার নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও আপাতত তাদের বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। চলমান কারফিউ ও সাধারণ ছুটির কারণে।
বেনজীর আহমেদের অবৈধ সম্পদ নিয়ে গত ৩১শে মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশ হয়। ১৮ই এপ্রিল ওই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। যদিও সংস্থাটির সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন অনুসন্ধানের সিদ্ধান্তের ব্যাপারটি ২২শে এপ্রিল গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন।
গত ২৩শে মে আদালতের আদেশে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের ৮৩টি দলিলের সম্পত্তি ও ৩৩টি ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেন আদালত। আর গত ২৬শে মে আদালত বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামের ১১৯টি জমির দলিল, ২৩টি কোম্পানির শেয়ার ও গুলশানে ৪টি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেন। সব মিলিয়ে ৬২৭ বিঘা জমি ক্রোক করা হয়েছে তাদের।
অপরদিকে ছেলের ১৫ লাখ টাকার ছাগল কেনার তথ্য ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ায় আলোচনায় আসেন রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মতিউর রহমান। পরে জানা যায়, তার বিরুদ্ধে ৪ঠা জুন অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। সে সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের সম্পদের অনুসন্ধানও করছে সংস্থাটি। এরই মধ্যে মতিউর ও তার পরিবারের ১ হাজার ১৯ শতক জমিসহ বেশ কিছু ব্যাংক হিসাব জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। গত ১১ই জুলাই এই আদেশ দেয়ার পর মতিউর পরিবারের সম্পদের নোটিশ জারি করেছে দুদক।
দুদক সূত্রে জানা যায়, শুধু বেনজীর-মতিউর নয়, সাম্প্রতিক সময়ে দুদকের জালে ধরা পড়া অন্য সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানেও গতি কমে গেছে কারফিউর কারণে।
সূত্রমতে, এই মুহূর্তে এক ঝাঁক সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে দুদকের টেবিলে।
গত মার্চ মাসে বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধানে নামার পরপর শুরু হয় সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদকে নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিষেধাজ্ঞার পর তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান আমলে নেয়ার জন্য আবেদন করেন এক আইনজীবী। পরবর্তীতে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ সংবাদ সম্মেলনে জানান, জেনারেল আজিজের বিষয়ে দুদক এ মুহূর্তে কিছু করছে না। দুদকের তফসিলে না পড়ায় তা আমলে নিতে পারছে না সংস্থাটি। অবশ্য এরপর, জেনারেল আজিজের সম্পদের খোঁজখবর নিয়েও সংবাদ প্রকাশ হয় গত জুন মাসে। ‘জেনারেল আজিজের তেলেসমাতি’ শিরোনামে সে সংবাদ প্রকাশের পর ফের আইনজীবী দুদকে অনুসন্ধান চেয়ে আবেদন করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আবেদনটি দুদকের যাচাই বাছাই কমিটিতে রয়েছে।
এদিকে বর্তমানে দুদকের অনুসন্ধানে রয়েছে পুলিশ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম শিমুলের নামে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগটি। গত মে মাসে সংস্থাটির উপ-পরিচালক মো. নুরুল হুদাকে দায়িত্ব দেয়া হয় অনুসন্ধানের জন্য। এরই মধ্যে তার সম্পদের তথ্য চেয়ে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠিপত্র পাঠানো হয়েছে। এমনকি শিমুল ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোকের আবেদন করা হয়েছে কমিশনের কাছে। তবে সে আবেদন এখন পর্যন্ত আদালত অবধি গড়ায়নি বলে জানা যায়।
বেনজীর, শিমুল ও মতিউরদের অনুসন্ধানের মধ্যে খবর বেরিয়ে আসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রথম সচিব (কর) আবু মাহমুদ ফয়সালের দুর্নীতির তথ্য। এক হাজার কোটি টাকা মূল্যের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুদক। যদিও সংস্থাটির অনুসন্ধান এই প্রথম নয়। ২০২২ সাল থেকে দুদক অনুসন্ধান করছে ফয়সালের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি নতুন করে আরেকটি নথিযুক্ত করে একসঙ্গে অনুসন্ধানের দায়িত্ব পেয়েছেন দুদকের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজ। গত ২৭শে জুন তার আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত ফয়সাল ও তার স্ত্রীসহ আত্মীয়দের নামে থাকা প্রায় ১৭ কোটি টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদ জব্দের আদেশ দেন। একই সঙ্গে ৮৭টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশও দেয়া হয় এদিন। দুদক সূত্রে জানা যায়, এনবিআর সচিব ফয়সালের এত সম্পদের নেপথ্যে রয়েছে রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য। ১৯ বছরের চাকরি জীবনে ঘুষ লেনদেনসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন ফয়সাল। অনুসন্ধানে নেমেই ফয়সাল ও তার স্ত্রী, শ্বশুর-শাশুড়িসহ স্বজনদের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও ব্যাংকে অর্থের তথ্য পেয়েছে দুদক। তবে চলমান কারফিউ ও সাধারণ ছুটির কারণে এই অনুসন্ধানটির কাজও স্থগিত রয়েছে। এদিকে এনবিআর ও পুলিশ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের খবরের সঙ্গে সঙ্গে আলোচনায় উঠে আসে রাজউক ও ওয়াসার উচ্চ পদের কিছু সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তার বিষয়ও। জানা গেছে, দুদকের অনুসন্ধানে ওই দুই দপ্তরের কর্মকর্তাদেরও নাম রয়েছে। এরই মধ্যে রাজউকের একজন প্রধান প্রকৌশলীর বিষয়ে অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধান করছে দুদক। এ ছাড়া রাজউকের নথি গায়েব, পূর্বাচল নতুন শহরে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে অনিয়মের বিষয়গুলো সামনে চলে আসে। যা নিয়ে দুদকের কার্যক্রমে গতি পায়। জানা গেছে, চলতি মাসে এক পরিচালক ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধেও মামলা করেছে দুদক। অপরদিকে ওয়াসার বেশ কিছু প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ পেয়ে সংস্থাটি একাধিক অনুসন্ধানে নেমেছে।
মতিউর, বেনজীর, আজিজ ও ফয়সাল, জাহাঙ্গীরসহ রাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের নিয়ে একটার পর একটা আলোচনা তৈরি হলেও তা এখন আড়াল হয়ে যাচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতির কারণে।
বাংলাদেশ সময়: ১১:০৫:০৪ ৯১ বার পঠিত