দ্য ডিপ্লোম্যাটের প্রতিবেদন কোটা ইস্যুর চেয়েও আরও গভীর এই প্রতিবাদ

প্রথম পাতা » জাতীয় » দ্য ডিপ্লোম্যাটের প্রতিবেদন কোটা ইস্যুর চেয়েও আরও গভীর এই প্রতিবাদ
বুধবার, ১৭ জুলাই ২০২৪



কোটবিরোধী আন্দোলন।

কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সড়কগুলোতে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করছেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী। স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের সরকারি চাকরির সুযোগ দেয়ার জন্য কোটা ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য অংশ সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। এই রিপোর্ট লেখার সময় এই প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলছিলই এবং তা থেকে বিরত হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হুমকি ও ভীতি প্রদর্শন সত্ত্বেও বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের দাবি নিয়ে তিরস্কার করে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা ও মন্ত্রীরা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নানা রকম অপকর্মের অভিযোগ তুলেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দল আওয়ামী লীগ।

অন্যদিকে প্রতিবাদী শিক্ষার্থীরা বলছেন, কোটা ব্যবস্থা বৈষম্যমূলক। এর মাধ্যমে যেসব মানুষ ক্ষমতাসীন দলের প্রতি পক্ষপাতী তাদেরকে সরকারি চাকরির সুযোগ দেয়া হয়। এর পরিবর্তে তারা মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ব্যবস্থার দাবি জানাচ্ছেন। কোটা ইস্যুর চেয়েও আরও গভীরে এই প্রতিবাদ।

আওয়ামী লীগ দাবি করে তারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে এবং শাসন করার নৈতিক কর্তৃত্ব তাদের আছে। তাদের এই দাবির মূলে আঘাত করেছে এসব ইস্যু। যদিও তারা ক্ষমতায় আছে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে। সেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু ছিল না। ছিল না অংশগ্রহণমূলক। বাংলাদেশ ক্রমশ কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে। এখানে শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জায়গা চরমভাবে সীমিত হয়েছে। কোটা পদ্ধতির মতো একটি একক ইস্যু বৃহত্তর অসন্তোষ প্রকাশের একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। কোটা বিরোধী প্রতিবাদ হলো একটি দেশে এক ধরনের ‘ডেমোক্রেটিক ব্রিকোলেজ’- যেখানে অসন্তোষ প্রকাশের জন্য বিরোধীদের কোনো রকম তথ্য পাওয়া এবং রাজনৈতিক স্থান দেয়া প্রত্যাখ্যান করে কর্তৃত্ববাদী নেতারা বিরোধীদের কণ্ঠরোধ এবং নীরব করে দেয়ার চেষ্টা করেন।

সাধারণভাবে ব্রিকোলেজ এমন সব কর্মকাণ্ডকে বোঝায় যা তাৎক্ষণিকভাবে হাতের কাছে পাওয়া বিকল্প উপায়। এটা কারখানায় বানানো জিনিসগুলোর মতো নিখুঁত ও সুন্দর হয় না। তবে উদ্দেশ্য সাধন করবে। এক্ষেত্রে একটি উত্তম উদাহরণ হলো- বাংলাদেশের কৃষকরা, যারা চীনের কাছ থেকে পানির পাম্প পেয়েছেন, তারা সেটাকে বর্ষা মৌসুমে বোটের ইঞ্জিনে রূপান্তর করেছেন। গণতান্ত্রিক ব্রিকোলেজ এমন কাজগুলোকে বোঝায়, যা একটি বৃহত্তর, রাজনৈতিক এবং গণতন্ত্রপন্থি সুবিধা তৈরি করার জন্য যেকোনো সুযোগকে কাজে লাগায়। মৌলিকভাবে, যখন কর্তৃত্ববাদী শাসকরা ভিন্নমতের কণ্ঠরোধ করতে চান, তখন গণতান্ত্রিক ব্রিকোলেজ কাজ করে।

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্রিকোলেজ হলো স্থান উন্মুক্তকরণ, কখনো কখনো নতুন ও অনাকাক্সিক্ষত স্থান বিষয়ক। এই মূলনীতির অধীনে সবার প্রতিবাদ করার অধিকার আছে এবং শোনার অধিকার আছে। কোটা বিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে আপত্তি তুলেছে ক্ষমতাসীন দল। তারা ক্ষমতায় থাকার জন্য এই সিস্টেমের ওপর নির্ভর করে।

প্রতিবাদী আন্দোলনে কোনো ব্যক্তি নেতৃত্ব দিচ্ছেন না। এ জন্য বিক্ষোভ দমনের চেষ্টায় কর্মকর্তারা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বাংলাদেশের ওয়াকিবহাল সূত্রের তথ্যমতে, এসব শিক্ষার্থী তাদের কর্মসূচিতে সমন্বয় করতে ইন্টারনেট ব্যবহার করে ম্যাসেজিং অ্যাপ ব্যবহার করছেন। তারা ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত। কোনো কেন্দ্রীয় সূত্র ছাড়াই এক গ্রুপ থেকে অন্য গ্রুপের কাছে বার্তা পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাদের ওপর যখন আইনপ্রয়োগকারীদের নজরদারি আছে তখন তারা এই উপায়ে নিজেদের মধ্যে সংগঠিত, সমন্বয় এবং সংযুক্ত থাকছে। ক্ষমতাসীনরা তাদেরকে দমন করার চেষ্টা করা সত্ত্বেও এই নতুন কৌশল ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা তাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখতে পারছেন।
বাংলাদেশের সরকারি কিছু কর্মকর্তার দুর্নীতি ও বেআইনি সম্পদ অর্জনের বেশ কিছু রিপোর্ট কয়েক মাস ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে।

এর মধ্যে আছেন দেশে গভীরভাবে কর্তৃত্ববাদের নেপথ্যের একজন প্রথম সারির ‘অ্যাক্টর’ সাবেক পুলিশ ও র‌্যাবের প্রধান বেনজীর আহমেদ, একজন ব্যুরোক্র্যাট এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা বিষয়ক একজন কর্মকর্তা। ‘হেভিলি মেশিনেটেড ভোটের মাধ্যমে’ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মধ্যেই এই প্রতিবাদ এবং দুর্নীতির খবরগুলো এসেছে। ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতাকে দৃশ্যত দৃঢ় করে, রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ক্ষমতাসীন দল কার্যত প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে জয়লাভ করেছে। তারা এটা করেছে একটি দুর্বল বিরোধীপক্ষের বিপরীতে, যে বিরোধী দলের সদস্যদের কঠোরভাবে নিপীড়ন করা হয়েছে।
সুতরাং এতই যদি ক্ষমতা দৃঢ় করে থাকে তাহলে কেন আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিবাদ মোকাবিলা এবং দুর্নীতি থামাতে পারছে না?

দুটি বিষয়- কোটা বিরোধী প্রতিবাদ এবং দুর্নীতির প্রকাশ শাসকরা কর্তৃত্বে এবং পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণের যে দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে। দুর্নীতির প্রকাশ এটাই বলে দেয় যে পারস্পরিক সাজুয্য, আত্মসাৎ এবং উচ্চপর্যায়ে দুর্নীতি আছে। এটি এমন একটি বৃত্ত যা কর্তৃত্ববাদকে সমর্থন করে, আর্থিক লাভের জন্য, অবৈধ সম্পদ অর্জনে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারকে লঙ্ঘন করে। তারা উভয়েই একই রকম সেন্টিমেন্ট দেখায়। এটা ক্ষমতাসীন দলের বৈধ শাসক হিসেবে দাবির প্রতি একটি আপত্তি। উভয়েই জনপ্রিয় একটি আকাক্সক্ষায় বলে যে, শক্তিধরদের জবাবদিহি করা হচ্ছে। এই গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার একটি বহিঃপ্রকাশ, যা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসারণ এবং স্বৈরাচারী শাসনের ১৫ বছর পরেও বিদ্যমান রয়েছে।

এই বছরগুলোতে শেখ হাসিনা দেশটিতে কর্তৃত্ববাদের আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। যেখানে সমালোচক, ভিন্নমতাবলম্বী এই বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ রকম নিষ্পেষণ করা হয়। এর মধ্যে আছে বানোয়াট মামলায় জেলবন্দি করা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও জোরপূর্বক গুম। যখন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ থাকার পরও মুক্ত থাকেন, বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রাজপথে সহিংসতার পরও মুক্ত থাকেন, তখন বিরোধী নেতাকর্মীদের বাধ্য করা হয় আদালতে হাজির হতে, বাধ্য করা হয় আত্মগোপনে যেতে অথবা জেলে পাঠানো হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিরোধী দলের অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৪০০ মামলা আছে। বিরোধীদের মিছিল, সভা বন্ধ করে দেয় পুলিশ। সাংবাদিক ড. শহিদুল আলম ও রোজিনা ইসলামের মতো সমালোচকদের কারাবন্দি করা হয়। ভীতির সংস্কৃতি গ্রাস করেছে সমাজকে, যেখানে নিরাপদ থাকার জন্য নিউজ আউটলেটগুলো স্বেচ্ছা সেন্সরশিপ আরোপ করে। রাষ্ট্রে আধিপত্য বিস্তার করে ক্ষমতায় থাকার ১৫ বছর পরও সমাজে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি সরকার।

গণতান্ত্রিক চেতনা ফিরিয়ে আনা এবং ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বলার গভীর এক আকাক্সক্ষা বাংলাদেশিদেরকে ভিন্ন এক জীবনে প্রবেশ করিয়েছে। যেখানে তাদের প্রতিবাদ, শাসকদের বিরুদ্ধে সমালোচনা গণতান্ত্রিক বিকলেপ এসে নতুন এক রূপ নিয়েছে।

(দ্য ডিপ্লোম্যাট অবলম্বনে)

বাংলাদেশ সময়: ০:৫১:৫০   ২৬ বার পঠিত  




জাতীয়’র আরও খবর


আয়নাঘরের আদ্যোপান্ত: পর্ব ১২
জাহিদ মালেক পরিবারের ৬০০০ শতাংশ জমির খোঁজ
শহীদদের মামলা নিয়ে ব্যবসা শুরু হয়েছে: সারজিস
আসাদুজ্জামান নূর ও মাহবুব আলী গ্রেপ্তার
সাংবাদিকদের চিফ প্রসিকিউটর আন্দোলন দমনে মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে
‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের আহ্বান সময়োপযোগী’
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম হত্যা মামলার প্রতিবেদন ১৫ অক্টোবর
সাবেক তিন আইজিপিসহ ৮৮ পুলিশের নামে হত্যা মামলা
আয়নাঘরের আদ্যোপান্ত: পর্ব ১১
ওরা প্রধানমন্ত্রীর লোক সেদিন যে রিপোর্ট প্রকাশ করা যায়নি (ভিডিও)

Law News24.com News Archive

আর্কাইভ