সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নাইমা হায়দার বলেছেন, আমি কখনও নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য দেখি না। একটা মেয়ে যা করতে পারে একটা ছেলেও তা করতে পারে। শুধু চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। ডেডিকেশন নিয়ে কাজ করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের ‘ফ্যাশন শো’ অনুষ্ঠানে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে উপস্থাপিকার প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা মডেল আইনজীবী পিয়া জান্নাতুল প্রশ্ন করেন, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য একজন মেয়েকে কোন বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত?
জবাবে বিচারপতি নাইমা হায়দার বলেন, আমি কখনও নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য দেখি না। একটা মেয়ে যা করতে পারে একটা ছেলেও তা করতে পারেন। যখন অনেক ছোট ছিলাম তখন আমি পাইলট হতে চাইতাম। বাবা জিজ্ঞেস করতেন, তুমি পাইলট হতে চাও কেন? আমি উত্তরে বলতাম— পাইলট হয়ে আমি সারা পৃথিবী ঘুরতে চাই। তখন আমার বাবা বলেছিলেন, পাইলট পেশাটা পুরুষের জন্য।
‘ছোট বেলা থেকে আমি একটু চঞ্চল প্রকৃতির ছিলাম। অনর্গল ইংলিশ বলতে পারতাম। বাবা বললেন, তুমি ইউনিভার্সিটির ভালো একজন লেকচারার হতে পারো। তখন আমি ক্লাস সিক্স কিংবা সেভেনে পড়ি। আমার স্বাস্থ্য ভালো ছিল। এক সময় আমার ভালো লাগতো এয়ার হোস্টেসদের। কী স্মার্ট! কী সুন্দর করে পোশাক পরে। বাবাকে বলতাম এয়ার হোস্টেস হতে চাই। বাবা আমাকে বলে দিলেন, তুমি তো এয়ার হোস্টেস হতে পারবে না! কারণ দেখ স্লিম প্রকৃতির মেয়েরা তো এয়ার হোস্টেস হয়। পরে বাবা বললেন, তুমি ইংলিশে অনার্স পড়। আমি বললাম ইংলিশে কেন পড়ব? কেন আইন পড়তে পারবো না? বাবা বললেন, আইন পেশা তো খুব চ্যালেঞ্জিং। বাবা কিন্তু আমার মতামতের বিরোধিতা করেননি। তিনি আমাকে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করে দিচ্ছিলেন। তখন বুঝতে পারিনি। এই বয়সে এসে বুঝতে পেরেছি। বাবা আমাকে বললেন, “ল’ প্রফেশন ইজ এ ভেরি চ্যালেঞ্জিং প্রফেশন”। ওই সময়ে নারীদের মধ্যে অ্যাডভোকেট সিগমা হুদা ও ব্যারিস্টার রাবেয়া ভুঁইয়াকে দেখতাম।
মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বিচারপতি নাইমা হায়দার বলেন, অবশ্যই আইন পেশা অন্য যেকোনো পেশার থেকে চ্যালেঞ্জিং। আমি তো আইন পড়লাম। প্রথমে ইউনিভার্সিটির লেকচারার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করি। কিন্তু আইনপেশা শুরু করার পর থেকেই আমি চ্যালেঞ্জ করলাম। প্রথম থেকেই আমি কয়েকজনের মধ্যে একজন ছিলাম। আমার স্বভাব চরিত্র একটু চঞ্চল প্রকৃতির। ১০ মাইল দূরে থেকে আমার হাসি শোনা যাবে। জোরে কথা বলছি, সেটা শোনা যাবে। প্রমাণ করতে চাই, আমি একজন সফল মানুষ। যদিও সফল মানুষ হতে পারিনি।
আমি যদি বিচারপতি না হয়ে আইনজীবী থাকতাম, চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি এখনকার সময়ের সেরা আইনজীবীরা আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হতো। আমার মা চেয়েছিলেন, আমি যেন লাইফে সেটেলডাউন করি। আল্লাহ হয়তো সেটাই দিয়েছেন।
মেয়েদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, যাই পছন্দ করো না কেন সেটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে করতে হবে। একদিনে যেমন বিখ্যাত সেফ হওয়া যায় না। ঠিক তেমনি একদিনে কিন্তু গান গেয়ে লতা মঙ্গেশকর হয়নি। একদিনে আজকের আশা ভোঁসলে হয়নি। যদি পেশার প্রতি প্যাশন থেকে থাকে, ডেডিকেশন থেকে থাকে তাহলে যেকোনো কিছু অর্জন করা সম্ভব। কোনো কিছু একদিনে হয় না। দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হয় সফল হওয়ার জন্য।
‘আজকে এখানে যাদের দেখতে পাচ্ছি খুব ভালো লেগেছে। আমি এটাই বলবো, নারী মনে করে কখনও নিজেকে ছোট ভেবো না। যেকোন কাজ প্যাশন নিয়ে ডেডিকেশন নিয়ে করলে সফল হতে পারবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও নারী উদ্যোক্তা মাসুমা মিথিলার উদ্যোগে পোশাক প্রদর্শনী এবং ফ্যাশন শো অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি বিচারপতি খিজির আহমেদ চৌধুরী, সিনিয়র আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম, শাহ মনজুরুল হক, ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনসহ আইনজীবীরা।
সাবেক প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর মেয়ে বিচারপতি নাইমা হায়দার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। এছাড়া কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কেল বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। কিছুদিন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে শিক্ষকতা করেন। ১৯৮৯ সালে জেলা আদালতে আইন পেশায় যোগ দেন নাইমা হায়দার। ১৯৯৩ সালে হাইকোর্টে আইনজীবী এবং ২০০৪ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ২০০৯ সালের ৬ জুন তিনি হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। ২০১১ সালের ৬ জুন হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। বিচারপতি নাইমা হায়দার অসংখ্য আলোচিত রায় দিয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১১:২৮:৪৬ ২১০ বার পঠিত